• শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪ ||

  • শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

  • || ১৯ মুহররম ১৪৪৬

মাদারীপুর দর্পন

খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়ক হবে কৃষি ঋণ

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ৩ ডিসেম্বর ২০২৩  

খাদ্য নিরাপত্তা সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক উন্নয়ন ভাবনার আলোচনায় শীর্ষে। যার প্রতিফলন ঘটেছে সহস্রাব্দের উন্নয়ন অভিলক্ষ ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টতে। এ দুটি অভিলক্ষ্যের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী ‘ক্ষুধার অবসান’। এসডিজির ১৭টি অভিলক্ষ্যের মধ্যে দুই নম্বরে স্থান পেয়েছে ‘ক্ষুধার অবসান’। অর্থাৎ পৃথিবীর সব মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। খাদ্যের জোগানের পর্যাপ্ততা, খাদ্য পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও নিরাপদ হওয়া এবং সব নাগরিকের খাদ্যের অধিগম্যতা বা প্রাপ্তি এ চার মাত্রার সমন্বয়ই হলো খাদ্যনিরাপত্তা। এক্ষেত্রে খাদ্যের জোগান ব্যবস্থা অটুট থাকা ও নাগরিকদের বাজার থেকে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ্য অর্জনই মূল কথা। খাদ্যের জোগান কেবল দেশজ উৎপাদননির্ভর নয়, অনেকাংশে তা বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বসবাস। যারা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি ভূখ- থেকে এ বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সংস্থান করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে সেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় উন্নতি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন। খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিনিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা সরকারের আগামীর লক্ষ্য। বাংলাদেশের কৃষির এরই মধ্যে খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর ঘটেছে।

আগামী দিনে রফতানিমুখী কৃষিতে বিপুল বিনিয়োগ তথা ঋণ প্রয়োজন। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাত্র চার শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণে গত বছর ৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে। এ তহবিল থেকে বড় ঋণ দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করতে এখন থেকে এই তহবিলে সর্বোচ্চ ঋণ সীমা ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সব ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা। এ তহবিল থেকে এরই মধ্যে কিছু ব্যাংক বড় ঋণ দিয়েছে। ডলার সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে গত বছরের নভেম্বরে এই পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এখান থেকে ব্যাংকগুলো মাত্র শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে অর্থ পায়।  কৃষি উৎপাদন বাড়াতে চলতি অর্থবছরে কৃষকদের ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক। নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্য যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে কৃষি ঋণের লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এবার চাহিদা বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৩০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা, বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো মোট ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করেছে, যা অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। টেকসই উন্নয়নে প্রধান তিনটি লক্ষ্য তথা দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা মুক্তি এবং সুস্বাস্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃষিঋণ সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এ ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে নতুন করে কয়েকটি বিষয় যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে-নতুন কৃষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ বিতরণ করতে হবে। পল্লী অঞ্চলে আয়-উৎসারী কর্মকাণ্ডে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হবে ৫ লাখ টাকা। ছাদ কৃষিতে অর্থায়ন করতে পারবে ব্যাংক। অর্থাৎ বাড়ির ছাদে বাগান করতে ঋণ পাবেন গ্রাহক। এছাড়া চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুচিয়া চাষে ঋণ বিতরণ করতে পারবে। মৎস্য খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ এবং প্রাণিসম্পদ খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করতে হবে। চরাঞ্চল, হাওড় ও অনগ্রসর প্রত্যন্ত এলাকায় কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণে দেওয়া হবে অগ্রাধিকার।

বিশ্বব্যাপী বিরাজমান মন্দাবস্থা। ধান-চাল-শাকসবজি-ফলমূল ও মাছ উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর হলেও গম-ভোজ্যতেল-চিনি-ডালসহ কিছু নিত্যপণ্য আমদানি করতে হয় এখনো। সরকার পর্যায়ক্রমে এসব ঘাটতিও কমিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। ধান-চালের পাশাপাশি গম, তেলবীজ ও অন্যান্য সহযোগী ফসল উৎপাদনে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি ও  জনবান্ধব এই আবেদনের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, দেশে কৃষিঋণ বিতরণে গতি বেড়েছে ইতোমধ্যেই। স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ পদ্ধতিও সহজ করা হয়েছে। কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনীশক্তি এবং মূল চালক।

করোনা অতিমারিসহ বিভিন্ন জাতীয় অর্থনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মন্দাবস্থা সর্বোপরি খাদ্যাভাব মোকাবিলায় দিন-রাত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশের মানুষকে। কৃষি ও  কৃষকরাই নিরন্তর অবদান রেখে চলেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে। দেশ বর্তমানে ধান-চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য মজুতও সন্তোষজনক। ফলে, খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা নেই দেশে। সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বাধিক জোর দিয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর।

এখন প্রশ্ন উঠেছে অর্থনীতিতে খাতওয়ারী এত বিনিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও কৃষি খাতে ঋণের বিনিয়োগ এত কম কেন? জাতীয় বাজেটের আলোকে এই খাতের বরাদ্দ অগ্রাধিকার তালিকায় আসে না কেন? সম্প্রতিক এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, দেশের  ৬১টি ব্যাংকের প্রায় ১০ হাজার শাখার অর্ধেকেরই বেশি গ্রামঞ্চলে, অথচ তাদের কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে অনীহা রয়েছে। সরকারি এক হিসাবে দেখা যায় গ্রামে ঋণ গ্রহণকারী কৃষক পরিবারের শতকরা ৭৫ ভাগই চড়া সুদে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে ঋণ নিয়েছে এনজিওর কাছ থেকে। ব্যাংকগুলো কাগজে কলমে গ্রামীণ শাখা খুললেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো শহরের মতো গ্রামীণ মানুষের বাণিজ্য, শিল্প ও ভোক্তা ঋণ বিতরণ করছে।

সরকারি এক হিসাবে বলা হয়েছে দেশে  প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে যাদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পেয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ, যা সংখ্যায় মাত্র ৬৫ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর মতে দেশের ৪১ লাখ গ্রামের পরিবার ঋণের জন্য ব্যাংকে আবেদন করলেও সফল হতে পারেনি এবং এর কারণ হিসেবে ব্যাংকের অনীহা ও প্রচারের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এর পরও ঋণ প্রক্রিয়ায় জটিলতা, পদ্ধতিতে ক্রুটি ও অলিখিত লেনদেন খরচ ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আর এই কৃষ্টির সঙ্গে নিজেদেরকে মেলাতে পারছে না। অথচ কৃষকদের ঋণ সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক যেমন বিকেবি ও রাকাব রয়েছে। তাছাড়াও অন্য ব্যাংকগুলোর জন্য মোট ঋণের কমপক্ষে ৫ শতাংশ কৃষিখাতে দেওয়ার বাধ্য বাধকতা রয়েছে।

বর্তমানে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের উপরে সুদ হার নির্ধারণ করে দিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংকগুলো একে লাভজনক বলে মনে করে না। এজন্য ব্যাংকগুলো এজেন্সি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এনজিওদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর ব্যাংকগুলো লাভবান হয়। 

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি নাগরিকের উচিত তার জমি থেকে কিছু না কিছু উৎপাদন করা। যা শুধু তাদের চাহিদাই মেটাবে না, দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হতেও সাহায্য করবে। বিশ্ব সংকটের কারণে দেশ যাতে কোনো সংকটের সম্মুখীন না হয়, সেজন্য আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’

সেই লক্ষ্যে ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প কাজ করছে। কৃষি ঋণ নীতিমালায় উল্লিখিত অধ্যায় বা ধারাগুলোকে সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে তফসিল ব্যাংকগুলোকে নীতি সহায়তা দিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা।