• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

উত্তরে নতুন আশা

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২৩  

অবহেলিত উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ শিল্পায়ন না হওয়া। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকায় এ অঞ্চলে যেমন পর্যাপ্ত কলকারখানা গড়ে ওঠেনি, তেমনি ব্যাহত হতো কৃষিকাজও। বিশেষ করে সেচ মৌসুমে বড় ধরনের সংকট তৈরি করে ডিজেলের ঘাটতি আর বিদ্যুতের লোডশেডিং। দূরত্বের কারণে নৌ ও রেলপথে চট্টগ্রাম থেকে উত্তরের জেলাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন তেল সরবরাহ করা দুরূহ ও ব্যয়বহুল। বড়পুকুরিয়া ছাড়া বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র না থাকায় এ অঞ্চলের চাহিদা পূরণ করা হয় দেশের মধ্যাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিদ্যুৎ এনে। দূর থেকে বিদ্যুৎ আসায় লো ভোল্টেজ সমস্যায় ব্যাহত হয় সেচ কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি সেচ মৌসুম থেকে এসব সমস্যা আর তেমন থাকবে না। কারণ, ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আসা শুরু হয়েছে। সেচকাজের পাশাপাশি সৈয়দপুরের ১৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও চলবে এই ডিজেল দিয়ে। একই সঙ্গে ভারত থেকে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎও আসছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে। ফলে উত্তরের ১৬ জেলায়, বিশেষ করে রংপুর বিভাগের আট জেলায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কারণে নিশ্চিত হবে জ্বালানি নিরাপত্তা।

বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনে ভারতের আসামের নুমালীগড় রিফাইনারি থেকে ডিজেল আসছে। এখন বছরে তিন লাখ টন ডিজেল আসবে পাইপলাইনে, যা পর্যায়ক্রমে ১০ লাখ টনে উন্নীত হবে।

বিপিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগে খুলনা ও চট্টগ্রাম থেকে রেল ওয়াগনের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে তেল আসতে সময় লাগত ৬-৭ দিন।  ওয়াগন সংকট, ধর্মঘট নানা কারণে প্রায়ই এই সরবরাহ ব্যাহত হয়। পাইপলাইনে ডিজেল আসায় সময় বাঁচবে। পাশাপাশি পরিবহন খরচও কমবে।

নীলফামারী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সফিকুল আলম বলেন, পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলে এখন শিল্পবিপ্লব হবে। অনেক উদ্যোক্তা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। অনেকে পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলেন, উত্তরে প্রচুর সবজি হয়। সঙ্গে অন্যান্য ফসলও হয় রেকর্ড পরিমাণে। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ও শ্রমিক মজুরিও অনেক কম। নিরবচ্ছিন্ন তেল ও বিদ্যুৎ পেলে এখানে কৃষিভিত্তিক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। উদ্যোক্তারা আগ্রহী হবেন। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও ঈশ্বরদী অঞ্চলের ৬৫টি প্রতিষ্ঠান গ্যাস সংযোগের আবেদন করলেও ৪/৫টি প্রতিষ্ঠানে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে আবেদনগুলো দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে।

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, দেশের খাদ্য চাহিদার ৫০ শতাংশ ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল উত্তরাঞ্চল থেকে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ অঞ্চলে এখনও বড় আকারে কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। যদিও এ অঞ্চলে মৌসুমি ফসল, বিশেষ করে শীতকালীন সবজি প্রচুর পরিমাণে হয়।  জ্বালানি ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত হলে এ অঞ্চলে অনেক কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে উঠবে।

উত্তরাঞ্চলে ডিজেলের বার্ষিক চাহিদা ৫ লাখ ৮০ হাজার টন। ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত কৃষি সেচ মৌসুমে ডিজেলের ব্যবহার বেড়ে যায়। নৌপথে চট্টগ্রাম ও খুলনা থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী ডিপোতে তেল আনা হয়। দিনাজপুরের পার্বতীপুর ডিপোতে রেলপথে তেল আসে। পাইপলাইনে তেল আসায় তেল পরিবহনের এই ঝক্কি কমে আসবে।

পার্বতীপুর ডিপোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ডিজেলের চাহিদা থাকে গড়ে ১৫ লাখ লিটার। বোরো মৌসুমে চাহিদা বেড়ে হয় ২০ থেকে ২২ লাখ লিটার। রেল, নৌ ও সড়কপথে ডিজেল পরিবহনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সেচ মৌসুমে ডিজেলের সংকট দেখা দেয়। পেট্রোল পাম্প  প্রতিনিধিরা অভিযোগ করে বলেন, এ সময় চাহিদা অনুযায়ী তেল পাওয়া যায় না। এখন পাইপলাইনে তেল আসায় এসব সমস্যা আর থাকবে না বলে জানান বিপিসির কর্মকর্তারা।

সেচ ও গরমে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উত্তরের ১৬ জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক ৮৯৫ মেগাওয়াট ও কয়লাচালিত ৪৪৪ মেগাওয়াট। বাকিগুলো তেলভিত্তিক। বর্তমানে এসব কেন্দ্র থেকে মাত্র হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, যার মধ্যে গ্যাস আর কয়লা থেকেই আসছে ৭০০ মেগাওয়াট।

দাম বেশি বলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ চালানো হয় কম। চাহিদার বাকি অংশ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে আনা হয়। বেশিদূর থেকে বিদ্যুৎ আনায় উত্তরের লো ভোল্টেজ সমস্যা প্রকট। গত ৯ মার্চ থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে। এখন দিনে ২০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। শিগগিরই তা ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হতে পারে। এর ফলে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেকটাই কমবে বলে আশা করছে সরকার।