• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

২ ডিসেম্বর ১৯৭১: পিছু হটতে থাকে হানাদার বাহিনী

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২ ডিসেম্বর ২০২৩  

১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এই দিন মুক্তি সংগ্রামে উত্তাল ছিল বাংলার মাটি। মুক্তিবাহিনী ধারাবাহিক বিজয় অব্যাহত রাখে-আরও নতুন স্থান দখল করতে থাকে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর প্রবল চাপ চলমান থাকে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। আর অপ্রতিরোধ্য বাঙালির বিজয়ের পথে পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল লড়াইয়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে থাকে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য মুক্তাঞ্চলের সৃষ্টি হয়।
মূলত নভেম্বরের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। সাথে সাথে পুরো দেশজুড়ে চলছিল গণপ্রতিরোধ।

প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হচ্ছিল পাক বাহিনী। তারই মাঝে একদিন মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরে আকস্মাৎ এমন এক হামলা চালায় যার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তান বাহিনী। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। মুক্তিবাহিনী পঞ্চগড় মুক্ত করে এগিয়ে চলছিল ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে।

পাক হানাদার বাহিনীর হামলায় একাত্তরের এই দিনে রামপুরা ও মালিবাগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। ডিসেম্বরের এ সময়টাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে তখন মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হতে শুরু করে।

ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য ও বৈঠক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২ ডিসেম্বর দিল্লিতে বলেন, মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতেই পূর্ববঙ্গে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযোগ উঠেছে, ভারত থেকে মুক্তিবাহিনীকে কাজ চালাতে দেওয়া হচ্ছে। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এতই দীর্ঘ যে তাদের আটকানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা ফিরিয়ে নিলেই কেবল সমস্যার সমাধান হতে পারে। ইন্দিরা তার বাসভবনে সমবেত কংগ্রেস কর্মীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।

এই দিন তিনটি পাকিস্তানি স্যাবর জেট দুপুরে আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে বোমা ফেলে যায়। খবরটি রাজধানীতে পৌঁছামাত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ ও প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লালসহ ঊর্ধ্বতন সেনা, বিমান ও নৌ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর নির্দেশ দেওয়া হয়, আগরতলার বিমানঘাঁটি ও শহরে পাকিস্তানি হামলার জবাব দিতে তারা যেন পাকিস্তানি এলাকায় ঢুকে পড়ে।

সারাদেশে যুদ্ধ

পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড়ে রিং আকারে প্রথম ও দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইন তৈরি করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় এদিন গভীর রাতে আক্রমণ করায় তারা পঞ্চগড় ছেড়ে চলে যায়। চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান তাদের দখলে আনতে সক্ষম হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পটিয়া থানা তাদের দখলে আনার জন্য মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। মুক্তিবাহিনী বিরিসিড়ির বিজয়পুরে পাক অবস্থানের ওপর অ্যামবুশ করে ৫ জন পাকহানাদারকে হত্যা করে। এখান থেকে মুক্তিবাহিনী রাইফেলসহ ২১ জন রাজাকারকে ধরতে সক্ষম হয়।

পাক কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন ভালুকা থেকে একদল রাজাকার সঙ্গে নিয়ে কাঁঠালি গ্রামে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করতে এলে মুক্তিবাহিনীর সেকশন কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন এবং তিন নং সেকশন কমান্ডার আবদুল ওয়াহেদের নেতৃত্বে পরিচালিত অতর্কিত আক্রমণে ৩ জন পাকহানাদার এবং ৭ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ জন পাকসৈন্য আহত হয়। পরে পাকহানাদাররা মৃতদেহগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়। কোম্পানি কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন আহমেদ, প্লাটুন কমান্ডার এমদাদুল হক ও নাজিম উদ্দিন খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহের ধানশুর ও কাটালী গ্রামের বড় রাস্তায় পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে ১৪ জন পাকসেনা ও ১৩ জন রাজাকার নিহত হয়।

একই দিন মশাখালী ও কাওরাইদ থেকে পাকবাহিনী রাজৈ গ্রামে লুট করতে এলে কোম্পানি কমান্ডার চাঁন মিয়া প্লাটুন কমান্ডার মজিবর রহমান ও নজরুল ইসলাম মুক্তিবাহিনীর দল নিয়ে পাকসেনাদের ওপর গুলি চালান। এই যুদ্ধে একজন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে আক্রমণ করে ২৭ হানাদারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে বেশকিছু গোলাবারুদও উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী।

এদিকে আখাউড়া, পঞ্চগড়, ভূরুঙ্গামারী, কমলাপুর, বনতারা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এতে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন লে. মাসুদ, সুবেদার খালেক, লে. মতিন, মেজর সদরুদ্দিন ও ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার। মুক্তিবাহিনীর ছোড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঢাকার রামপুরা বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের পাঁচটি বিদ্যুৎ সাব স্টেশন ও দুটি পেট্রোল পাম্প বিধ্বস্ত হয়।