• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

১৪ অপরাধে জড়িত রোহিঙ্গারা

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ৩ আগস্ট ২০২২  

খুনোখুনি, অপহরণ,ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা,চাঁদাবাজি,মানব পাচারসহ ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গা অপরাধীরা। এসব অপরাধ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে শিবিরগুলোতে ৯৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

এছাড়াও সর্বশেষ গত দুই-আড়াই মাসে মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) দুই নেতাসহ অন্তত পাঁচজন খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে মঙ্গলবার ( ১ আগস্ট) বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে নুরুল আমিন (২৬) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন।

জানা গেছে, ক্যাম্প-০৪  এক্সটেনশন এর আই ব্লকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত নুরুল আমিন ওই ক্যাম্পের আবু শামার ছেলে। নিহত আমিন রোহিঙ্গা হলেও জিকে নামের একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন। চাকরি শেষে ঘরে ফেরার পথে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশিদ ।

এছাড়াও ২২ জুন মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং এর আগে ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। একই মাসে ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিন (৩০) এবং ৯ জুন রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

এছাড়া মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬) নামের দুই স্বেচ্ছাসেবক। নিহতদের মধ্যে দুইজন আরসা নেতা মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্য মো. সেলিম (৩০)। তারা নিহত হন গত ১৫ জুন। এর এক সপ্তাহের ব্যবধানে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে একই গ্রুপের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড শীর্ষ  সন্ত্রাসী হাশিমের সহযোগী মো. শাহকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে আরসা সদস্যরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানান, রোহিঙ্গা শিবিরে আইন-শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মো. নাইমুল হক।

তিনি জানান,২২ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ১৭ নম্বর ক্যাম্পের সাব ব্লক ৯৪ এর  একটি দোকানের সামনে মোহাম্মদ শাহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর তার সঙ্গে থাকা লোকজন গলায় গুলি করে পালিয়ে যায়।

‘মোহাম্মদ শাহ তথাকথিত আরসা সেকেন্ড-ইন-কমান্ড শীর্ষ  সন্ত্রাসী হাসিমের সহযোগী ছিল। হাসিম অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়। এরপর মো. শাহ মিয়ানমারে পালিয়ে যায়। হাসিমের মৃত্যুর পেছনে তার হাত থাকতে পারে বলে আরসার সদস্যরা শুরু থেকে সন্দেহ পোষণ করে আসছিল। এর জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে যোগ করেন মো. নাইমুল হক।

নিহত মোহাম্মদ শাহ রোহিঙ্গা শিবিরের একজন চিহ্নিত দুষ্কৃতিকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা দুষ্কৃতিকারী তালিকায় তার নাম শীর্ষে রয়েছে জানিয়ে নাইমুল হক বলেন, দীর্ঘদিন মিয়ানমার এবং জিরো পয়েন্ট এলাকায় লুকিয়ে থাকার পর  কিছুদিন আগে তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরে আসে এবং তখন থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে আসছিল।

পাঁচ বছরে ৯৮টি হত্যাকাণ্ড:

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা খুনোখুনি, অপহরণ,ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা,চাঁদাবাজি,মানব পাচার ও অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধে জড়িত। এসব অপরাধের দায়ে ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত থানায় ১ হাজার ৯০৮টি মামলা হয়েছে । আর  এ সময়ের মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি।

রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার অপরাধ কর্মকান্ড বাড়ছে:

গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা ও তাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে নিহতের পরিবারের সদস্যরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা’কে দায়ি করে আসছিল। এরপর ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসায় স্বশস্ত্র হামলা চালিয়ে গুলি করে একটি মাদ্রাসার ৬ জন ছাত্র শিক্ষককে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এসব বড় ঘটনার পরেও একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না। এমনকি রোহিঙ্গা শিবিরে রোহিঙ্গাদের স্বশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা)  উপস্থিতির বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওঠে এলেও এত দিন আইনশৃংখলা বাহিনী বা সরকারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়।

সর্বশেষ ১৩ জুন পুলিশের দেওয়া রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী শিবিরে আরসা সদস্যদের উপস্থিতি স্বীকার করে পুলিশ।

ওই তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, মুহিব উল্লাহ আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনীর নির্দেশে হত্যা করা হয় এবং মুহিব উল্লাহ আরসা প্রধানের চেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়ে যাচ্ছিলেন বিধায় তাঁকে হত্যা করে আরসার সদস্যরা। মুহিব উল্লাহর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর কারণে আরসার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গা শিবিরে আরসা সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ রোহিঙ্গারা। শিবিরে ডাকাতি,চাঁদাবাজি,খুন,ধর্ষনসহ এমন কোন অপরাধ নেই যেখানে আরসা জড়িত নয়। তাদের মতে, নানা অপরাধের পাশাপাশি আরসা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে কাজ করে আরসা।

জঙ্গি সংগঠনটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায়। এই হামলার জবাবে সর্বাত্মক ও নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ও রাখাইনেরা। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে কয়েকদিনের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তাঁদের এখনও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার সরকার।

প্রসঙ্গত সরকারি হিসাবে কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ ও নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরসহ প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। যাদের আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহায়তায় খাবারসহ মানবিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব রোহিঙ্গা আগমনের প্রায় পাঁচ বছর হলেও এখনও একজনকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।