• বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

  • || ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

রূপপুর যেন এখন একখণ্ড রাশিয়া

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২  

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে একসময়ে এলাকার গ্রামবাসীর মধ্যে ছিল নানা সংশয় ও উদ্বেগ। তবে প্রকল্পে কয়েক হাজার দেশি-বিদেশি কর্মীদের মানুষের কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক কেন্দ্র বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য। এখন সকলের মুখে মুখে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জয়গান। আর অপার সম্ভাবনাময় আগামীর জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধুর প্রতীক্ষা।

নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ছোঁয়ায় বদলে গেছে ঈশ্বরদীর প্রত্যন্ত গ্রাম রূপপুর। একসময় সন্ধ্যা হলেই যেখানে গাঢ় অন্ধকারে নামত রাত্রির নিস্তব্ধতা। সেখানেই এখন দিন-রাত কর্মচাঞ্চল্য। প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক রাশিয়ান, বেলারুশ, কাজাখসহ বিদেশীদের পদচারণায় বদলে গেছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র। চরের বিরান ভূমিতে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী সুদৃশ্য আবাসিক ভবন। রয়েছে ঝকঝকে শপিংমল, বিদেশী আদলের রেস্তোরাঁ ও রিসোর্ট।

২০১৫ সালে রূপপুরের নতুন হাট এলাকায় ছিল শুধু কাঁটাতারের বেড়া। চারদিকে ধু-ধু ফাঁকা মাঠ আর দুই-একটি অস্থায়ী স্থাপনা। আগের বিরান ভূমিতে এখন দেখলে রাশিয়ার আধুনিক শহর ভেবে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখানকার পরিবেশ বদলে রাশান আর বাঙালির সাংস্কৃতিক মিশ্রক্রিয়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। রাশিয়ান ও বাঙালি এখন এতে অপরের বন্ধু। সন্মোধনও চলে ‘বন্ধু’ বলেই। রূপপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী পাকশী, সাহাপুর ও ঈশ্বরদীতেও লেগেছে এখন পরিবর্তনের ছোঁয়া। পাল্টে গেছে জীবনচিত্র। বিদেশি সংস্কৃতির ছোঁয়াও লেগেছে জীবনে। ফল ও সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে প্রয়োজনের তাগিদে অনেকেই শিখেছেন রাশিয়ার ভাষা। রাশিয়ার নাগরিকদের সাথে কেনাবেচা করতে করতে বাঙালিরা অনেকেই শিখেছেন রাশান ভাষা।

পদ্মা নদীর তীরে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে ঘিরে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ শুরুর পর হতে বদলে যাচ্ছে এলাকার চিত্র। প্রকল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে কয়েক হাজার বেকার যুবকের। ভাগ্য বদলের পাশাপাশি বদলে গেছে জীবনযাত্রা ও সামাজিক চিত্র।

এখানে বিদেশীদের জন্য গ্রিন সিটি নির্মাণ হয়েছে। ২০ তলা বিশিষ্ট ২০টি ভবনে থাকছেন প্রকল্পের বিদেশী কর্মীরা। গ্রীণসিটির বাইরে চারপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রিসোর্ট, বিপণি বিতানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। বিদেশি নাগরিকদের কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজন মেটাতে পাকশী, সাহাপুর, রূপপুর ও ঈশ্বরদী শহরে গড়ে উঠেছে একাধিক বিপণি বিতান, আধুনিক শপিংমল, সুপারশপ, রিসোর্ট ও থ্রিষ্টার মানের তারকা হোটেল। রূপপুর প্রকল্পে দেশী-বিদেশীদের কর্মসংস্থান হওয়ায় মার্কেটের দোকানে রাশিয়ানসহ অনেক ক্রেতা আসে। আগের চেয়ে ব্যবসা এখন ভালো হচ্ছে। আগে যেখানে রাইচ মিল ছিল, ব্যবসা ভালো না হওয়ায় সেটা ভেঙে মার্কেট তৈরি হয়েছে।

নতুন হাট ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থাপনায় রুশ সংস্কৃতির ছোঁয়া। সাইনবোর্ডে ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে রুশ ভাষা। রেঁস্তোরার নাম রাখা হয়েছে রুশ ডাইন, রুশ ফ্যাশন। প্রকল্পের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বড় পরিবর্তন। হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানে এলাকায় আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে বলে জানালেন পাকশীর সাবেক চেয়ারম্যান এনামূল হক বিশ্বাস ।

উপজেলা প্রকৌশলী এনামুল কবীর প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। রূপপুর প্রকল্পের ভারী মালপত্র রেলপথে আনা-নেওয়ার জন্য ৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৬ কিলোমিটার ঈশ্বরদীতে নতুন রেলপথ নির্মিত হয়েছে।

১৯৬১ সালে রূপপুরে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর দীর্ঘ সময় পেরোলেও এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর পূর্ণোদ্দমে কাজ শুরু হয়। ১ হাজার ৬২ একর জমির ওপর স্থাপিত ২,৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে থাকছে দুটি ইউনিট। প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০২৩ সালে। সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট পরের বছর চালুর কথা রয়েছে। প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে রাশিয়া।

রূপপুর পারমাণবিকের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর জানান, এই প্রকল্পে দেশি-বিদেশি ২৫ হাজার প্রকৌশলী ও শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের মধ্যে রাশিয়া, বেলারুশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫ সহস্রাধিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক রয়েছেন।

পাকশী কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সাথে কথা হয় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে। তিনি বলেন, একসময়ে আশপাশের গ্রামবাসীর মধ্যে ছিল নানা সংশয় ও উদ্বেগ। আদৌ প্রকল্প নির্মাণ হবে কিনা। এখন প্রকল্পে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান আর দেশি-বিদেশিদের কেন্দ্র করে ঈশ্বরদীর এই এলাকা হয়ে ওঠেছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। বদলে গেছে এলাকার মানুষের ভাগ্য। এখন মানুষের মুখে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জয়গান।