• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

শহরের একটুখানি বিনোদন ‘শকুনি’ লেক

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারি ২০১৯  


‘শকুনি লেক’। মাদারীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি কৃত্রিম লেক এটি। শহরের মানুষের মানুষের কাছে একটু খানি বিনোদনের জায়গা এই লেকের চারপাশ। সম্প্রতি সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যমে লেকটিকে দর্শনার্থীদের কাছে আরো বেশি জনপ্রিয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। সকাল,দুপুর, বিকেল কিংবা সন্ধ্যা। বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষের উপস্থিতি থাকে লেকের চারপাশ ঘিরে। তবে বিকেলের দিকে দর্শনার্থীদের মিলনমেলা বসে লেক ঘিরে। জমে উঠে বাহারি হালকা খাবারে দোকান ও বাচ্চাদের নানা খেলনা সামগ্রীর দোকানে। লেকের চারপাশের বিশ্রাম বেঞ্চে থাকে অবসর সময় কাটানোদের ভিড়। কেউ বসে কেউ বা দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে লেকের স্বচ্ছ কালো জলের মৃদু ঢেউ আর জল ছোঁয়া বাতাস! 

সম্প্রতি উন্নয়নের মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধনের ফলে মাদারীপুরবাসীর কাছে একমাত্র বিনোদন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সুবিশাল এই লেকটি। অপরূপ সাজে সজ্জিত এই লেকজুড়ে এখন বিনোদনপ্রেমী মানুষের একটুখানি বিনোদনের আশ্রয় হিসেবে পরিনত হয়েছে। সারাদিনই ভ্রমন পিয়াসী মানুষের পদচারনায় এক রকম মুখোর থাকে এই শকুনী লেক। তবে দিনের সূর্য যখন বিকেলের দিকে গড়িয়ে যায় তখন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় লেকের চারধার। এ যেন এক মিলনমেলা মানুষের।

শকুনী লেকের সৌন্দর্য বর্ধন কাজ শেষ হওয়ায় মাদারীপুর জেলার প্রধান বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে লেকটি। দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মাদারীপুরবাসীর। প্রতিদিন লেকটির চারপাশ ঘুরে দেখতে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। বিকেল হলে যেন মানুষের মেলা বসে লেকের পাশজুড়ে। 

সন্ধ্যা নামলে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয় লেকের চারপাশে। নানা রংয়ের আলোর প্রতিফল তখন লেকের পানিতে বাতাসের মৃদু ঢেউয়ে দোল খায়। আর স্বপ্নচারী মানুষ ভাবনার জগতে ডুবে থাকে লেকের জলের মৃদু ঢেউয়ের ছন্দে।

শকুনি লেকটি ঘুরে দেখা গেছে, শহরের বিনোদন প্রেমীদের একমাত্র ভরসা এই লেক। সকাল কিংবা বিকেল একটু বিনোদনের আশায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই ছুঁটে আসেন শহরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা শকুনি লেকের পাড়ে। এখানে আসলেই দর্শনার্থীরা নিতে পারে মুক্ত নিশ^াস। 

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কৃত্রিমভাবে এই লেক সৃষ্টি করা হলেও সময়ের ব্যবধানে নিজে নিজেই সেখানে ফুটে উঠছে প্রাকৃতিক চিত্র। মাদারীপুর শহরের মাঝামাঝি শকুনি নামক এলাকায় ২০ একর জমির ওপর চল্লিশ দশকের দিকে লেকটি খনন করা হয়। পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গাগড়ার খেলায় যখন মাদারীপুর শহরের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে তখনই ঐতিহাসিক এ শহরকে তৃতীয়বারের মতো রক্ষা করার লক্ষ্যে ১৯৪৩ সালে খনন করা হয়।

চল্লিশের দশকে এ অঞ্চলে মাটিকাটা শ্রমিকের অভাব থাকায় ২০ একর আয়তনের এই লেক খনন করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চল থেকে দুই হাজার শ্রমিক ভাড়া করে আনে। বিপুল সংখ্যক বিদেশী শ্রমিক এক টানা কাজ করে প্রায় ৯ মাসে এর খনন কাজ সম্পূর্ণ করে।

জনশ্রুতি রয়েছে, ‘প্রায় ২০০ বছর পূর্বে এই লেকের স্থানে ছিল একটি ডোবার মতো পুকুর। সেই পুকুরে বাস করতো শকুন আকৃতির কিছু ভূত। ধীরে ধীরে এই লেকটি বড় হতে থাকে। আপনাআপনিই ডোবা থেকে পুকুরে পরিনত হয়। তবে পরবর্তীতে এটা খনন করে আরো বড় করা হয়। সে সময় ভূতের ভয়ে কেউ একা লেকপাড়ে আসতো না। সেই থেকে এই লেকের নাম হয়েছে শকুনী লেক।’ তবে এই জনশ্রুতির কোন ভিত্তি নেই আধুনিক মানুষের কাছে।

তবে মাদারীপুর পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, ১৮৫৪ সালে  এই শকুনী লেকটি খননের মধ্য দিয়ে মাদারীপুর শহরের পত্তন হয়। এবং দীর্ঘদিন অযতœ আর অবহেলায় লেকটি পড়ে থাকলেও ২০১৩ সালে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে এর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু করে মাদারীপুর পৌরসভা। 

সরকারি অর্থায়নে ‘শকুনী লেক’ প্রকল্পে ঘিরে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, শহীদ কানন, শিশু পার্ক, স্বাধীনতা অঙ্গন, এমপি থিয়েটার মঞ্চ, শান্তি ঘাটলা, পানাহারসহ মাদারীপুর ঘড়ি নামে একটি টাওয়ার। যার প্রতি বছরে এই শকুনী লেকটির রক্ষনাবেক্ষন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ লক্ষ টাকা।


লেকটিতে ঘুরতে আসা এক দর্শনার্থীরা জানান, ‘মনের প্রশান্তির জন্য এই শকুনী লেকের পাড়ে আসি। এখানে আসলে এক ভিন্ন রকম শান্তি অনুভব করা যায়। এখানকার পরিবেশটাও চমৎকার।

ফেসবুক ভিত্তিক সংগঠন ‘মাদারীপুর ফটো গ্যালারি’র অন্যতম সদস্য তানজিল চৌধুরী বলেন,‘ মাদারীপুর শহরে বিনোদনের জায়গা বলতে এই লেকটি। এখন যে সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে তাতে বেশ আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। অসংখ্য মানুষ আসছে ঘুরতে। একটু সময় কাটাতে। আমরা আমাদের মাদারীপুর ফটো গ্যালারিতে এই লেকের চমৎকার ছবিগুলো প্রকাশ করেছি। যাতে করে শহরের বাইরের মানুষও এই লেক সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে।’


মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র খালিদ হোসেন ইয়াদ জানান, ‘লেকটি শুধু মাদারীপুরবাসীর চিত্ত বিনোদনের জন্য নয়, জেলাকে পর্যটন শহর হিসেবে রূপান্তর করতে এই লেকের গুরুত্ব ব্যপক।
পর্যটন শহর হিসেবে সারাবিশে^ জেলাকে পরিচিতি করে দেয়ার নতুনমাত্রা হিসেবে যুক্ত হবে এই শকুনী লেক।’ 

দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্তায় শরীরে যেমন ক্লান্তি ভর করে তেমনি ক্লান্তি এসে ভর করে মানুষের মনেও। মনের এই ক্লান্তি দূর করতে বিনোদন কেন্দ্রের বিকল্প নেই। একটু মানসিক প্রশান্তির জন্য মানুষ ঘুরতে বের হয় পরিবার-পরিজন বা প্রিয়জনকে নিয়ে। অবসাদ দূর হয়ে ঘরে ফেরে সতেজ-ফুরফুরে মেজাজ ও কাজের নতুন উদ্যোম নিয়ে। দেশের মফস্কল শহরগুলোতে তেমন কোন বিনোদন কেন্দ্র না থাকায় কখনো নদীর পার বা খোলা প্রান্তরে ঘুরে সময় কাটায় মানুষেরা। দূর করার চেষ্টা করে মনের ক্লান্তি। শকুনি লেক মাদারীপুরবাসীর কাছে এক বিনোদনের জায়গা। ক্লান্তি দূর করে সতেজ মনে ঘরে ফেরার স্থান!