• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন
ব্রেকিং:
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে: রাষ্ট্রপতি শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ: প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশুপালন ও মাংস প্রক্রিয়াকরণের তাগিদ জাতির পিতা বেঁচে থাকলে বহু আগেই বাংলাদেশ আরও উন্নত হতো মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রতি নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রী আজ প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ উদ্বোধন করবেন মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব না খাটানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর দলের নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানায় শেখ হাসিনা মুজিবনগর দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০২০  

রমজান মাসে রোজা ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি এবং মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতগুলোর অন্যতম। রোজাকে মহান আল্লাহ নিজের দিকে সম্বোধিত করে বলেছেন, ‘মানুষের সব আমল তাঁর জন্য; তবে রোজা ছাড়া। কেননা তা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়ে বেশি সুগন্ধিযুক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ৫৯২৭)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘রোজা ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ তা ত্রুটিযুক্ত করা হয়।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস ২২৩৩)

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেন, ‘রোজাকে ঢালস্বরূপ বলার কারণ হলো, তা মানুষকে পৃথিবীতে পাপাচার থেকে রক্ষা করে এবং পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে।’ (আরবাউনান-নাবাবিয়্যা বি-তালিকি ইবনে উসাইমিন, পৃষ্ঠা ৫৫)

 

রোজার প্রধান তাপর্য খোদাভীতি অর্জন

রোজার বহুবিদ কল্যাণ ও পুরস্কারের কথা কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যার অন্যতম তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা এবং এটা রোজার অন্তর্নিহিত প্রধান তাৎপর্য। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেন, ‘তাকওয়া বা পরহেজগারির শক্তি অর্জনে রোজার একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কেননা রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার বিশেষ শক্তি অর্জিত হয়। প্রকৃতপক্ষে সেটাই তাকওয়া বা পরহেজগারির ভিত্তি।’ (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)

আরবি ভাষাবিদদের মতে, তাকওয়া শব্দের মৌলিক অর্থ দুটি সংরক্ষণ ও পরিহার। ব্যক্তি পার্থিব ও অপার্থিব সব ক্ষতিকর বিষয় পরিহারের মাধ্যমে নিজেকে সংরক্ষণ করলে তাকে মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু বলা হয়। ড. রাশিদ বিন হুসাইন আবদুল কারিম বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘তাকওয়া হলো আল্লাহর আদেশ পালন ও নিষেধ পরিহারের মাধ্যমে তোমার ও জাহান্নামের আগুনের মধ্যে একটি আড়াল তৈরি করা। এটাই ইহকাল ও পরকালের সব কল্যাণের আধার। আল্লাহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবাইকে তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন, তিনি আল্লাহভীরুদের আমল গ্রহণ করেন।’ (আদ-দুরুসুল ইয়াওমিয়্যা : ২/১৫৬)

রোজার অন্তর্নিহিত তাপর্য

দার্শনিক আলেমরা রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বর্ণনায় যা বলেছেন তার মূলকথা হলো, মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার ভেতর ফেরেশতাসুলভ বৈশিষ্ট্য জোরালো করাই রোজার মূল তাৎপর্য। রোজার মাধ্যমে মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি দুর্বল হয় এবং সে ধৈর্য, সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সৎসাহস ও আনুগত্যের শক্তি অর্জনের মাধ্যমে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার শক্তি অর্জন করে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) রোজার বেশ কিছু অন্তর্নিহিত তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অনেক সময় মানুষ সত্য ইলহামের মাধ্যমে এটা বুঝতে পারে যে অভ্যন্তরীণ পাশবিক প্রবৃত্তি তাকে মানবিক পূর্ণতায় পৌঁছতে বাধা সৃষ্টি করছে। আর সে কারণেই ফেরেশতার বৈশিষ্ট্যের অনুগামী হতে পারছে না। তাই সে তার পশুস্বভাবকে খারাপ ভাবতে থাকে এবং তা দমন করার পথ খুঁজে বেড়ায়। তখন সে তা দমনের জন্য ক্ষুিপপাসাকে অবলম্বন করে, স্ত্রী সাহচর্য ত্যাগ করে, মুখ, অন্তর ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এগুলোর দ্বারা সে আত্মিক ব্যাধির চিকিৎসা করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘অনেক সময় মানুষ নিজেই জানতে পারে—প্রবৃত্তিকে জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণে রাখাতেই মানুষের সাফল্য। কিন্তু প্রবৃত্তি বিদ্রোহী হয়ে যায়। কখনো জ্ঞানের নিদর্শন মানে, কখনো আবার মানে না। তখন তার জন্য অনুশীলন অত্যাবশ্যক হয়। তাই রোজার মতো কোনো কষ্টকর কাজে প্রবৃত্তিকে নিয়োজিত রাখতে হয়। রোজা প্রবৃত্তিকে দমন করে এবং আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি পালনে বাধ্য করে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ : ১/২৩০-২৩১)

ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘রোজার উদ্দেশ্য হলো, মানুষ তার ভেতর আল্লাহর গুণগুলোর অন্তত একটি যেন ধারণ করে। তাকে বলা হয় ‘সামাদিয়্যাত’ বা অমুখাপেক্ষিতা। সে যতটা সম্ভব ফেরেশতার অনুসরণের মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে মুক্ত হবে। কেননা ফেরেশতা প্রবৃত্তির তাড়না থেকে পবিত্র আর মানুষের মর্যাদা পশুর ঊর্ধ্বে। এ ছাড়া প্রবৃত্তির তাড়না থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তাকে জ্ঞান ও বিবেচনার শক্তি দেওয়া হয়েছে। ফেরেশতার তুলনায় তার অবস্থান এই বিবেচনায় নিচু যে তার ওপর প্রবল হয় এবং তা থেকে আত্মরক্ষায় তাকে প্রচণ্ড রকম সাধনা করতে হয়। যখন সে তাড়নার স্রোতে ভাসতে থাকে, তখন সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে যায় এবং আর যখন তাড়নার ওপর বিজয়ী হয়, তখন সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যায় এবং তার মর্যাদা ফেরেশতার ওপর উন্নীত হয়।’ (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ১/১১২)

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘রোজার উদ্দেশ্য হলো মানুষের প্রবৃত্তি ও মন্দ স্বভাব থেকে মুক্ত হওয়া এবং মানবিক গুণাবলিতে ভারসাম্য তৈরি করা। যার মাধ্যমে সে সৌভাগ্যের চূড়ান্ত স্তরে উন্নীত হতে পারবে এবং চিরস্থায়ী জীবনের জন্য আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারবে। ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে তার চৈতন্য শাণিত হয় এবং একটি সীমা পর্যন্ত প্রবৃত্তির তাড়না দুর্বল হয়। তার স্মরণে আসে, কত অসহায় মানুষ শুকনো রুটির মুখাপেক্ষী। ফলে তার ওপর শয়তানের প্রভাত খর্ব হয় এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে এমন কাজে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে—যা তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিকর। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রোজা আল্লাহভীরুদের জন্য লাগাম, মুজাহিদদের জন্য ঢাল ও নৈকট্যশীল মানুষের জন্য সাধনাস্বরূপ।’ (জাদুল মাআদ : ১/১৫৬)

তাপর্যের ভিত্তিতে রোজার তিন স্তর

অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও তার অর্জনের ভিত্তিতে সাধক আলেমরা রোজার তিনটি শ্রেণিবিন্যাস করেন। তা হলো : ক. সাধারণ শ্রেণির রোজা, খ. বিশেষ শ্রেণির রোজা, গ. অতি বিশেষ শ্রেণির রোজা।

সাধারণ শ্রেণির রোজা : তা হলো পেট ও লজ্জাস্থানকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত রাখা। এই শ্রেণির রোজা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও মর্যাদাশূন্য।

 

বিশেষ শ্রেণির রোজা : পানাহার ও যৌনতা ছাড়াও হাত, পা, চোখ, কান, জিহ্বাসহ সব অঙ্গ পাপমুক্ত রাখা। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ দিকেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ‘যখন তুমি রোজা রাখো, তোমার কান, চোখ ও জিহ্বাও যেন রোজা রাখে মিথ্যা ও পাপ থেকে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস ৮৮৮০)

যারা এই স্তরের রোজা সম্পন্ন করে, তাদের বলা হয় সালিহিন বা নেককার বান্দা।

 

অতি বিশেষ শ্রেণির রোজা : নীচু চিন্তা ও জাগতিক ভাবনা থেকে মনের রোজা এবং আল্লাহা ছাড়া সব কিছু থেকে তাকে মুক্ত করা। আল্লাহ ও পরকাল ছাড়া অন্য কিছু ভাবনা এই শ্রেণির রোজা ভঙ্গ করে দেয়। আর যদিও সে জাগতিক কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করে, তবে তা শুধু দ্বিনের স্বার্থেই।

নবী (আ.), সিদ্দিকিন ও আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। (আল্লামা ফায়িজ আল-কাশানি, আসরারুল ইবাদাত, পৃষ্ঠা ২৫৩-২৫৪)

 

তাপর্যহীন রোজা নিষ্ফল

একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো নিজের রোজার মাধ্যমে আল্লাহভীতি অর্জনের চেষ্টা করা এবং ধীরে ধীরে নিজের রোজার স্তরকে উন্নীত করা। তাৎপর্যহীন রোজা মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব কোনো কাজে আসে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ১৯০৩)

অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘কত রোজাদার আছে, যাদের রোজার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। কত নামাজ আদায়কারী আছে, যাদের রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই জোটে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬৯০)