• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল বাংলা একাডেমী

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

 


১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণে সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। একাডেমীর সভাপতি সৈয়দ মুর্তাজা আলী এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমীর পরিচালক প্রফেসর কবীর চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই দিনই বাংলাভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। একমাত্র কুমিল্লার শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ করেন এবং উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কোন বাঙালি মুসলমান প্রতিবাদ করেননি। এটা লজ্জাজনক ইতিহাস।

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র ভাষার আন্দোলন ছিল না; বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এর সাথে জড়িত ছিল।

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করব না। কারণ, তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এ অবস্থায় হয়ত কিছু কিছু ভুল হবে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে। 

স্বাধীনতার পর আমাদের সাথে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে আচরণ করা হয়েছে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের দালাল বলা হয়েছে। এমন কি ভাষা আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানি করা হয়েছে বলা হতো। বাঙালি হিসেবে আমরা অনেক উদারতার পরিচয় দিয়েছি। তা না হলে আমরা বাংলাকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাতে পারতাম। কিন্তু সেদিন আমরা উর্দুর সাথে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলাম।

বাঙালির স্বজাত্যবোধকে টুটি চেপে হত্যার জন্যে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বার বার এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত হেনেছে, আর তাকে প্রাণ দিয়ে প্রতিহত করেছে এ দেশের তরুণরা। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ক’জন আছেন? বিবেকের কাছেই তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে। আপনাদের লেখনী দিয়ে বের হয়ে আসা উচিত ছিল এ দেশের গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। 

তিনি বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সন্তান সূর্যসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রচেষ্টাই করা হয় নাই। তাঁর কথা বলতে আপনারা ভয় পান। কারণ, তিনি ছিলেন হিন্দু। এঁদের ইতিহাস লেখা এবং পাঠ করার জন্যে দেশবাসীর কাছে আহবান জানাই। একদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা যেত না। কিন্তু আজ এই জাতীয়তাবাদ সত্য। একে বোধ করতে পারে এমন কোন ক্ষমতা নাই। এই প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতি একতাবদ্ধ হয়েছে। নিজেদের দাবিতে বাঙালিরা আজ ঐক্যবদ্ধ। 

বঙ্গবন্ধু বলেন, ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল এই বাংলা একাডেমী। ১৯৫২ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এই ভবনে বসেই ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলির আদেশ দিয়েছিলেন। তাই, যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালে ক্ষমতায় এসে এখানে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করে। এই বাংলা একাডেমীকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচারী সরকার কত খেলাই না খেলেছে, তা এ দেশের মানুষের জানা আছে। বাংলা একাডেমীর মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ৩ লাখ টাকা সরকার বার্ষিক বরাদ্দ করেছে। এর জন্যে কাকে দোষ দেব! যারা এসব করছে, সে আমলারা তো এ দেশেরই ছেলে। বাংলা একাডেমীর ভিতরের সব কথাই আমি জানি। লোক বদল করে নতুন নতুন লোক এনে বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণের যে চেষ্টা চালানো হয়েছে তাও জানি।

স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা একাডেমী যে সপ্তাহ পালন করছে সে সপ্তাহ বাংলাদেশের জীবনে এক কঠিন সপ্তাহ। ফেব্রুয়ারির এই দিনেই বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা, এই সপ্তাহেই কুর্মিটোলার বন্দিশিবিরে হত্যা করা হয়েছে সার্জেট জহুরুল হককে, এই সপ্তাহেই শহীদ হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা, আর এই সপ্তাহেই কারফিউ নিষেধাজ্ঞা লঙ্গন করে আত্মহুতি দিয়েছে
এদেশের অসংখ্য মায়ের অসংখ্য নাম না জানা সন্তান।

স্বৈরাচারী চক্র সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে কোন কোন প্রফেসরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু কই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক তো সে স্বৈরাচারী কার্যকলাপের প্রতিবাদে তখন পদত্যাগ করেন নাই। তখন অধ্যাপকরা একযোগে পদত্যাগ করলে আন্দোলনে এত রক্তক্ষয়ের প্রয়োজন হতো না।

মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার প্রতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। এই মুক্ত পরিবেশে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অতীত ভূমিকা ভুলে স্বজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। জনগণের জন্যেই সাহিত্য। এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না।

আমরা জনগণের দাবি আদায়ের জন্যে রাজনীতি করি। তবে তার মানে এই না যে, আমরা ক্ষমতা চাই না। আমরা দাবি আদায়ের জন্যেই ক্ষমতায় যেতে চাই। ক্ষমতা পেলে আমরা একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করব। আমাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্যেই এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত আছে। তবে দাবি আদায় না হলে
আমরা ক্ষমতা ছেড়ে চলে আসব। 

জয় বাংলা!

তথ্যসূত্র: এই দেশ এই মাটি গ্রন্থ।