• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

বহুমুখী প্রকল্পে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিপ্লব

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১০ এপ্রিল ২০২১  

১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। দেশজুড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন। তাই সব খাতের মতো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দিকে নজর দিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যতদূর এগিয়েছে তার সবটুকু সূচনা হয়েছে স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বিনির্মাণে তিনি-ই প্রথম বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শক্তির ওপর গুরুত্ব দেন।

১৯৭২ সালে ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতি আদেশ নং-২৭ এর মাধ্যমে দেশের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ খনিজ তেল ও গ্যাস কর্পোরেশন (BMOGC) গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে এর নামকরণ করা হয় পেট্রোবাংলা। তিনি জ্বালানি খাতকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম আইন ও পেট্রোলিয়াম পলিসি প্রণয়ন করেন। উক্ত আইন ও পলিসির আওতায় তিনি দেশীয় কোন মূলধন বা বিনিয়োগ ছাড়াই বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে তৈল গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘উৎপাদন বণ্টন চুক্তি’ পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন। বর্তমানে এই মডেলটি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলেও ওই সময়ে পৃথিবীর অনেক দেশই এই মডেলটির গুরুত্ব অনুধ্যান করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি আদেশ নং-৫৯ এর মাধ্যমে দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য বিদ্যুৎখাত পুনর্গঠন করেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ESSO Eastern Inc -কে অধিগ্রহণ করে এদেশে জ্বালানি তেল মজুদ সরবরাহ ও বিতরণে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত এসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানসমূহই আজও এদেশের তেল সেক্টরের নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করছে।

১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই দিনে তিনি জাতীয় স্বার্থে দেশের বৃহৎ পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র (তিতাস, বাখরাবাদ, রশীদপুর, কৈলাশটিলা ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেল ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে (১৭ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা) কিনে নিয়েছিলেন। যার বাজার মূল্য বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ কোটি টাকা। জাতির পিতার এই পদক্ষেপ ছিল বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অংশ হিসেবে জাতীয় স্বার্থে নীতিগত সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন। 

 

আজকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যতদূর এগিয়েছে তার সবটুকু সূচনা হয়েছে স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে - সংগৃহীত

আজকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যতদূর এগিয়েছে তার সবটুকু সূচনা হয়েছে স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে - সংগৃহীত

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৪০ (১) (খ) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগর ও বাংলাদেশের মহিসোপানে অবস্থিত সব খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। জাতির পিতা গ্রামীণ উন্নয়ন এবং নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করার জন্য গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়নের বিষয়টিকে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন (অনুচ্ছেদ-১৬)। বঙ্গবন্ধুর এই বৈপ্লবিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বে এটি একটি অনুসরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

জাতির পিতা ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৪৩ (১) (খ) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগর ও বাংলাদেশের মহীসোপানে অবস্থিত সকল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ The Territorial waters and Maritime Zone Act প্রণয়ন করেন। 

পচাত্তরে জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার পর সব কিছুই থমকে যায়। বিদ্যুতের জন্য প্রাণ দিতে হয় অনেক কৃষককে। ৯৬ সালে নতুন করে দেশের পথচলা শুরু করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে। সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে জাতিসংঘের ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন (UNCLOS) অনুসমর্থন (Ratiffiation) করেন। এই সমুদ্র আইন অনুসমর্থনের ফলেই বঙ্গোপসাগরে আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন দেখেন। এরপর থেকেই গতি পায় দেশের সব খাত। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যাপক উন্নয়ন।

২০০৯ সালে ৪৬ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। এখন দেশে ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। চলতি মুজিববর্ষের মধ্যে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার কাজ এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণ সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দেশের প্রতিটি ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে ১১ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণা অনেকটা স্বপ্ন মনে হলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এই বছরের ডিসেম্বরে মুজিববর্ষের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হবে। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ফলেই মাত্র ১২ বছরেই বিদ্যুৎ খাতে বড় বিপ্লব ঘটেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবিশ্বাস্য উন্নয়নের রূপকার এবং স্বপ্ন দ্রষ্টাই হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরপর স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে গেছে। মূলত জাতির পিতার দেখানো পথেই এই উন্নয়ন। এখন ঘরে ঘরে পৌঁছেছে বিদ্যুৎ। এগিয়ে যাচ্ছে জ্বালানি খাতও। এরই মধ্যে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৯৯ শতাংশ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।  ২০২৪, ২০৩০ ও ২০৪১ সালের সম্ভাব্য চাহিদা ও লক্ষ্য সামনে রেখে খাতটিকে আরো এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। 

বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় লোডশেডিং শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। নির্ধারিত সময়ের আগে এই শতভাগ বিদ্যুতের লক্ষ্য পূরণে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতাও ছিল। এর মধ্যে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন নেয়া ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আবার মানুষ নিজের গ্রাম, আদি নিবাস ছেড়ে ‘মাঠে-প্রান্তরে’ কিংবা নতুন সড়কের পাশে বাড়িঘর তৈরি করছে। ফলে বিদ্যুতের বর্ধিত চাহিদার জোগান দেয়ার পাশাপাশি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপনসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিদ্যুৎ বিভাগকে এগোতে হয়েছে। এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সাফল্যের দৃষ্টান্তও রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল ২৭টি। যা বর্তমানে ১৩৭টি। মাত্র ১২ বছরেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ১১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ২৪ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। ১২ বছর আগে গ্রাহক ছিল এক কোটি আট লাখ। বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার, তা এখন প্রায় ১৪ হাজার সার্কিট কিলোমিটার। গ্রিড সাবস্টেশন ছিল ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ, তা বেড়ে এখন প্রায় ৫০ হাজার এমভিএ। ২০০৯ সালে বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। এখন প্রায় ৬ লাখ কিলোমিটার। ১২ বছর আগে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এখন বিতরণ লস: ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। 

 

 

বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জ্বালানি সংকটের কারণে ২০০৯ সালের আগে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দেয়। পরিস্থিতির উত্তরণে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার মিশ্র ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্যাসের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়। সরকার তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং সৌর, বায়ু, বায়োগ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে উদ্যোগ নেয়। সরকারের ধারাবাহিকতা স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হয় এলএনজি আমদানি। নীতিমালা সহজ করায় বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করে। সরকারের এই উদ্যোগের ফলে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেয়। 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুৎ খাত ছিল চরম অস্থিতিশীল। ওই সময় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন খুবই কম থাকায় দিন-রাত লোডশেডিং লেগেই থাকতো। দ্রুততম সময়ে চাহিদা ও উৎপাদনে ভারসাম্য রক্ষায় সরকার ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেয়। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ায় এ খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। এরপর সরকার মধ্যমেয়াদী ও পরে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয়। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে মিশ্র জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তেল-গ্যাসের পাশাপাশি কয়লা এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়।

বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হওয়ায় লোডশেডিং হওয়ার সুযোগ নেই। মূলত লোডশেডিং হলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকলে একদিকে সংযোগ দিয়ে অন্যদিকে সংযোগ বন্ধ রাখা। উৎপাদন বেশি থাকায় সে অবস্থা আর নেই। তারপরও মাঝেমধ্যে লোডশেডিং হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বর্তমানে দুটি বিষয়ের জন্য লোডশেডিং দেখা দেয়। একটি হলো— এখন সারাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়নে প্রচুর কাজ হচ্ছে, উন্নয়নকাজের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করতে হয়। সে কারণে কোনো একটি লাইনে কাজ হলে সেটাকে বন্ধ রাখলে ওই এলাকায় তখন বিদ্যুৎ থাকে না। দ্বিতীয় কারণ হলো— উৎপাদন ও গ্রাহক বাড়ছে কিন্তু ট্রান্সফিউশন ডিস্ট্রিবিউশন শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। সে কারণে কিছু জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো আরো চিহ্নিত করে কাজ করছি। আগামীতে এগুলোও থাকবে না। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানির বড় একটি প্রসার হয়েছে। বর্তমানে ৫৮ লাখ সোলার হোম সিস্টেম দিয়ে গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। বায়ু বিদ্যুতের জন্য উইং ম্যাপিং হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২ বছরের মধ্যেই মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে নেবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য হলো গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। ফলে কমবে কার্বন নিঃসরণ ও সরকারি ভর্তুকি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদের সরকার বিভিন্ন প্রকার প্রণোদনা প্রদান করছে।

দেশে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে ওঠে ঢাকায়। বিংশ শতকের প্রথম বছর। আর এর আর্থিক সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহ। ৭ ডিসেম্বর, ১৯০১ সালে প্রথম ঢাকার রাস্তায় বিদ্যুতের বাতি জ্বলে ওঠে। এর পূর্বে ১৯০১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা পৌরসভা কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানানো হয় যেসব রাস্তায় ও এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে তার নাম। পৌরসভার অধীনে বিদ্যুৎব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ‘দি ঢাকা ইলেকট্রিক ট্রাস্টি’ নামে পরিষদ গঠন করা হয়। 

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পাকিস্তান সরকার দেড় বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। কিন্তু তখন দেশে মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেয়নি। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার বঙ্গবন্ধু রাশিয়ার সহায়তা নিয়ে দেশে নতুন করে বিদ্যুৎ খাত পুনর্গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবার দেশ পিছিয়ে যায়। তখন দেশে বিদ্যুতের সিস্টেম লস বেশি থাকায় দাতারা দেশের বিদ্যুৎ খাতে অর্থ দিতে চায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইপিপি নীতি গ্রহণ করা হয়। তখন দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বার্জ মাউন্টটেন্ড বিদ্যুৎ নিয়ে আসা হয়। এ সময় সরকার ক্যাপটিভ নীতি করলে শিল্পে বিদ্যুৎ দেয়া হয়। এরপর ২০০৯ সালে আবার বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তখন থেকে নানা রকম নীতির পরিবর্তন করে সরকার বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার করে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আজ বিদ্যুৎ খাত এবং দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর এখন সাশ্রয়ী এবং মানসম্মত সরবরাহই বড় চ্যালেঞ্জ। সারাবিশ্বেই পরিবর্তন এসেছে। বিদ্যুৎ সেক্টরেও সেই পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। প্রথম দফায় ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতের পুনর্গঠন চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল। তখন সরকার বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। এরপর ২০০০ সালে আবার জামায়াত বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। তখন লোডশেডিংয়ের জন্য রাস্তায় মিছিল হয়েছে। 

২০০৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার করে। জামায়াত-বিএনপি সরকারের কারণে তখন দেশ ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। আর্থিক সংকট ছিল। কেউ বিনিয়োগ করতেও চায়নি। কিন্তু এরপরও সরকারের উদ্যোগে দুই থেকে তিন বছরে দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকারের নীতিই বিদ্যুৎ খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। ভবিষ্যৎ চাহিদা মাথায় রেখে পায়রা, মাতারবাড়ি, রূপপুর, রামপালে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি খাতে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল, ঢাকা-চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ-হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর এবং বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে তেল সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়। আমাদের প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদ্যমান উন্নয়ন,অর্জনকে টেকসই করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নেও বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা জরুরি।

এদিকে, জ্বালানি খাতে সরকারের সাফল্যের কথা উঠে এসেছে ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনে। সদস্যভুক্ত ৮৪টি দেশসহ মোট ১৩৩টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে র‍্যাংকিং প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিল। এর মধ্যে র‍্যাংকিংয়ে স্থান পেয়েছে ১২৮টি দেশ। ২০২০ সালে নিরাপদ জ্বালানি নিশ্চয়তায় শীর্ষ দেশ ও এ খাতে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া ১০টি দেশের তালিকাও তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

 

 

জ্বালানি খাতে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় স্থান পেলেও সামগ্রিক পারফরম্যান্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪তম। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষ দশে থাকা দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। এরপর আছে সুইডেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র ও নিউজিল্যান্ডের নাম। অন্যদিকে জ্বালানি খাতে দ্রুত উন্নতি করা শীর্ষ ১০টি দেশ হচ্ছে কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, কেনিয়া, বাংলাদেশ, হন্ডুরাস, ঘানা, নিকারাগুয়া, ইথিওপিয়া, তাজিকিস্তান ও মঙ্গোলিয়া।

তবে সংস্থাটি বলছে, জ্বালানি খাতের উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের জিডিপিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। সক্ষমতা পাওয়ায় ডলারের মান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। 

জ্বালানি সরবরাহ বিবেচনায় গত পাঁচ বছরে মানসম্মত জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে বাংলাদেশে। এ সময়ে জ্বালানির প্রাপ্যতা বেড়েছে ৬ শতাংশ, সরবরাহ সক্ষমতা বেড়েছে ১১ শতাংশ এবং মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে ৯ শতাংশ। এসবের বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রিড সম্প্রসারণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানো, কেন্দ্র নির্মাণ, একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দেয়া। যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।

সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখনো ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে দেশে। একই সঙ্গে কয়লা, ডিজেল ও উচ্চমূল্যের জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ করা হচ্ছে। এর বাইরে ৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে প্রতিনিয়ত জ্বালানি সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না (অফগ্রিড) সেসব এলাকায় সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে জ্বালানি সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ যাতে কয়লাভিত্তিক বৃহত্তর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে না পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এসব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় স্বার্থে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক প্রকল্পসহ প্রয়োজনীয় সব প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। জ্বালানিভিত্তিক এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার মহেশখালী ও মাতারবাড়িতে একটি এবং পায়রাতে একটি এনার্জি হাব গড়ে তুলছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বৈপ্লবিক সাফল্য দেখিয়েছেন। পৃথিবীর কম দেশই এতো অল্প সময়ে এ রকম সাফল্য দেখাতে পেরেছে। 

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২৮ কিলোওয়াট যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৪৭০ কিলোওয়াট (দ্বিগুণেরও বেশি)। একই সময়ে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভুক্ত ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৮ শতাংশ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ৩ হাজার ২৬৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে সরকারের বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। 

 

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি ‘এনার্জি ডিপ্লোমেসি’-কে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও দ্বি-পাক্ষিক পর্যায়ে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ভারত থেকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ আনার জন্যে ভেড়ামারায় যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরার সঙ্গেও ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৬-৭ শতাংশ (১১৬০ মেগাওয়াট) ভারত থেকে আসছে; যা দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের গড় মূল্যের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী।

বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, মাত্র সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের জায়গায় দেশে এখন উৎপাদন সাড়ে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। নতুন নতুন কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজও শেষ পর্যায়ে। ৩ কোটি ৯৪ লাখ গ্রাহক পেয়েছে বিদ্যুতের সংযোগ।

তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার পর আবিষ্কৃত হয়েছে ১৭টি গ্যাসফিল্ড। শক্তিশালী হয়েছে রাষ্ট্রীয় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি- বাপেক্স। অনুসন্ধান আরো গতিশীল করায়, ড্রিলিং বেড়েছে। এখন গ্যাসের দৈনিক গড় উৎপাদন ২ হাজার ৭শ ঘনফুট।

বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের প্রায় ৭০ শতাংশ পূরণ করে। দেশে এখন আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রের সংখ্যা ২৭টি পেট্রোবাংলা কর্তৃক সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশে মোট গ্যাস মজুদের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট এবং উত্তোলনযোগ্য মজুদের পরিমাণ ২৭ দশমিক ৮১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। 

দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্যাস সঞ্চালন ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে হবিগঞ্জ জেলার মুচাই ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল জেলার অ্যালেঙ্গাতে গ্যাস কমপ্রেসর স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এ বছরের মধ্যে বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে ৩১টি উন্নয়ন কূপ খনন, ২২টি কূপের ওয়াকওভার এবং ৫৯টি অনুসন্ধান কূপ খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে অগভীর সমুদ্রের ৩টি ব্লকে এবং গভীর সমুদ্রের ১টি ব্লকে ৫টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি একক ও যৌথভাবে দেশে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত রয়েছে। 

দেশে তেল, গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ২ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট হতে ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত করেছে। ৮৬২ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন নতুন নির্মিত হয়েছে। 

 

 

ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য আরো বেশি হবে। এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকার দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সরকার রূপকল্প-২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে জিটুজি ভিত্তিতে এলএনজি আমদানি করছে। এলএনজি আমদানির লক্ষ্যে এরই মধ্যে মহেশখালীতে দৈনিক প্রায় ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ভাসমান সংরক্ষণাগার ও পুনঃগ্যাসায়ন ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম বলেন, দেশে এখন ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল তৈরি হয়েছে। এখন তরল গ্যাস আমদানি ও গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে ৭ থেকে ৮শ এএমএমসি। 

এদিকে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুরের খালাশপীর, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ি ও দীঘিপাড়ায় এবং বগুড়ায় জামালগঞ্জে মোট ৫টি কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব কয়লাক্ষেত্রে কয়লার মোট মজুদের পরিমাণ ৭ হাজার ৯৬২ মিলিয়ন টন। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কয়লাক্ষেত্রগুলো থেকে কয়লা উত্তোলন করা গেলে তা বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। ফলে ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমে আসবে। সে বিবেচনাতেই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে তা বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিপি) জ্বালানি তেল আমদানি, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ, মজুদ ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের মজুদ প্রায় ১৩ দশমিক ২৭ লাখ মেট্রিক টন। ২০০৯-২০১৮ সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তরল জ্বালানি সুষ্ঠু নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও জ্বালানি তেল সরবরাহ কোনো সংকট বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। দেশের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে প্রাপ্ত গ্যাস কনডেনসেট সমৃদ্ধ হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রে শুরু থেকেই ফ্রাকসনেশন প্লান্টে কনডেনসেট প্রক্রিয়াকরণ করে পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন জাতীয় পেট্রোলিয়াম পদার্থ উৎপাদন করা হচ্ছে।

জ্বালানি তেল আমদানি উৎস বহুমুখী করার লক্ষ্যে বর্তমানে ৫০ শতাংশ তেল জিটুজি ভিত্তিতে ১১টি দেশ থেকে এবং ৫০ শতাংশ তেল টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয় করা হচ্ছে। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির একটি নতুন ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। গভীর সমুদ্র থেকে সরাসরি পাইপ লাইনের মাধ্যমে দ্রুত সহজ, নিরাপদ ও ব্যয় সাশ্রয়ীভাবে শোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাসের জন্য সরকার কুতুবদিয়ায় (Single point moorning with double pipeline (SPM) স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য পাইপ লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়াও উড়োজাহাজের জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য পিতলগঞ্জ হতে কুর্মিটোলা এভিয়েশন ডিপো পর্যন্ত জেট ফুয়েল পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, আগামী ১৫ বছরে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে একশ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে অন্তত এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে, তা শিল্পায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। এক্ষেত্রে শিল্পায়নের বড় উপকরণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করাকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এসব খাতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করছে।