• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদকদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ৪ অক্টোবর ২০২০  

প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদকদের কাছে দেশ হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিশাল বাজার তাদের আকৃষ্ট করছে। তাই প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদকরা এ দেশে কান্ট্রি অফিস চালু করছে। কান্ট্রি অফিস দিতে না পারলে প্রতিনিধি নিয়োগ করছে। এসবের ফলে সংশ্লিষ্টদের ব্যবসার পরিধি বড় হচ্ছে, মার্কেট শেয়ার বাড়াতে সহায়তা করছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, এ দেশে যাদের কান্ট্রি অফিস নেই বা কোনও প্রতিনিধি নেই, সেসব কোম্পানির প্রযুক্তি পণ্যের দেখভালের জন্য প্রতিবেশী দেশ বা পার্শ্ববর্তী অন্য কোনও দেশের প্রতিনিধিরা কাজ করেন। তবে কান্ট্রি অফিসের দায়িত্বে যারা আছেন তারা মনে করেন, কান্ট্রি অফিস থাকা মানে উৎপাদকরা সে দেশকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। সে অফিসে যদি দেশীয় লোকজন কাজ করে তাহলে বোঝা সহজ যে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বা প্রিন্সিপাল অফিস সব বুঝেই দেশীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তারা মনে করেন, একজন বিদেশির পক্ষে এ দেশের কান্ট্রি প্রধান হয়ে কাজ করাটা কিছুটা সমস্যার। এখানে সংস্কৃতিগত একটা পার্থক্য থাকে, ভাষাগত সমস্যা থাকে, ক্রেতাদের আকাঙ্ক্ষাটা সহজে ধরতে পারে না তারা। আর দেশীয় লোকজন হলে মার্কেট, ডিস্ট্রিবিউটর, ডিলারদের সঙ্গে ভালো করে জানাশোনা থাকে। ফলে তাদের কাজ করতে সুবিধা হয়।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব পণ্যের কান্ট্রি অফিস বা প্রতিনিধি নেই সেসব পণ্যের বাজার দেখভাল ডিস্ট্রিবিউটররা করে থাকেন। সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো বাজার পেলে বা বাজারের আকার বড় হতে থাকলে তখন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান কান্ট্রি অফিস দেয় বা প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়।

বাজার সূত্রে জানা গেছে, নতুন কোনও পণ্যের বাজারে প্রবেশ বা পণ্যের বাজার ধরতে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো এমডিএফ (মার্কেট ডেভেলপ ফান্ড) দিয়ে থাকে। আগে ফান্ডের পরিমাণ বেশি থাকলেও সাম্প্রতিককালে (করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আগে) তা কমে গেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে উৎপাদকরা এমডিএফ দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সভাপতি মো. শাহীদ উল মুনীর বলেন, ‘কান্ট্রি অফিস যে কোনও দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশকে তারা প্রযুক্তির একটা হাব হিসেবে ধরে। গন্তব্য মনে করে। তারা দেখে বাজার কত বড়। বাজার যত বড় হবে ততোই তারা এ দেশকে গুরুত্ব দেবে। এতে করে দেশে এফডিআই (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) আসে। সরাসরি নিয়োগের ফলে রেমিট্যান্সও আসে। অনেক ধরনের সুবিধা রয়েছে।’

এ দেশে রয়েছে ডেলের নিজস্ব অফিস। বেশ বড় সেটআপ। ডেল কম্পিউটারের এ দেশীয় ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান বলেন, ‘কোনও প্রতিষ্ঠানের যখন কোনও দেশে দীর্ঘমেয়াদে কোনও পরিকল্পনা থাকে তখন তারা সে দেশে অফিস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের চিন্তা করা উচিত বাংলাদেশ কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ তারা তখন বাংলাদেশকে ছোট বা বড় দেশ হিসেবে দেখে না, দেখে পূর্ণাঙ্গ দেশ হিসেবে। ফলে এটাকে আমি ওই দেশের শক্তি বলে মনে করি।’

কোনও দেশে অফিস থাকলে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়, সরাসরি বাজার দেখা যায়, ক্রেতাদের সহজে সহযোগিতা করা যায়, মোট কথা নানামুখী কাজ করা যায়। এফডিআই আসে। সরকার প্রপার্লি ট্যাক্স, ভ্যাট পায়। ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ে ভূমিকা রাখা যায়। অন্য দেশে বসেও এদেশে ব্যবসায় পরিচালনা করা যায়। তা পণ্য বিক্রি বাড়াতে সাহায্যও করে। এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইউসিসির (কয়েকটা পণ্যের পরিবেশক) প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সারোয়ার মাহমুদ খান বলেন, ‘এমডিএফ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। কোনও মেলায় অংশ নিতে হলে বা বড় কোনও ক্যাম্পেইনে যেতে গেলে বাজেট প্রয়োজন হয়। সেটা বারবার নক করে (উৎপাদকদের) এমডিএফ আনতে হয়। তাও পুরোটা দিতে চায় না। অর্ধেকটা দেয় অনেক সময়। আগেও এমনটা দিতো। তবে এখন বেশি কথা বলে আনতে হয়।’

তিনি জানান, দেশকে গুরুত্ব দেওয়া, প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ, সঠিক বাজার তথ্য, প্রতিযোগী কোম্পানিদের অবস্থান জানা, তথ্যের জন্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো এ দেশে অফিস চালু করে নয়তো প্রতিনিধি নিয়োগ করে। অফিস বা প্রতিনিধির মাধ্যমে তারা সঠিক তথ্য নিয়ে মার্কেট প্ল্যান তৈরি করে, বাজারে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। তিনি মনে করেন, দেশে অফিস থাকলে বা প্রতিনিধি থাকলে পরিবেশক বা আমদানিকারকদের পক্ষে চাপমুক্ত থেকে কাজ করা সম্ভব।

তাইওয়ানের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আসুসেরও কান্ট্রি অফিস রয়েছে বাংলাদেশে। এ কান্ট্রি অফিসের বয়স একেবারে কম নয়। সুপরিসর অফিসে রয়েছেন ৮/৯ জন কর্মী। আসুসের কান্ট্রি ম্যানেজার আল ফুয়াদ বলেন, ‘বাংলাদেশের গুরুত্বটা বুঝতে পেরেছিল বলেই আসুস অনেক আগেই এ দেশে কান্ট্রি অফিস চালু করেছে। দেশে আসুসের মার্কেট শেয়ার ৩৫ শতাংশ। ফলে কান্ট্রি অফিসের আলাদা একটা গুরুত্ব আছে প্রিন্সিপাল অফিসের কাছে।’

আল ফুয়াদ বলেন, ‘যে কোনও কান্ট্রি অফিস সেই পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ করে। ব্র্যান্ড নিয়ে প্ল্যানিং, মার্কেটিং প্ল্যান সাজাতে পারে। কোন পণ্যটা মার্কেটে আসবে, চাহিদা কী তা কান্ট্রি অফিস বুঝতে পারে। এটাই তো কান্ট্রি অফিসের কাজ। কান্ট্রি অফিস থাকলে ভোক্তারা সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। কোনও সার্ভিস পেতে গ্রাহকদের দীর্ঘ সময় ধরে ঘুরতে হয় না।’

তিনি মনে করেন, নিজেদের বিজনেস নিজেদের লোকজন দিয়েই করতে হয়। ডিস্ট্রিবিউটররা, ডিলাররা তাদের মতো করে দেখবে। তিনি জানান, এখন মার্জিন ভালো থাকছে সবার। কান্ট্রি অফিসের ফলে এফডিআই আসছে, সেখান থেকে এমডিএফ নিয়ে বাজার উন্নয়নে কাজ করা হয়। তিনি আরও জানান, দেশে আসুসের আয় দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে দেশ হিসেবে বাংলাদেশও আসুসের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে।

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গিগাবাইটের এ দেশীয় ব্যবস্থাপক মো. আনাস খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কান্ট্রি অফিস স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি। আমরা আমাদের বাজারের তথ্য মেইন অফিসকে জানাতে পারছি। সে অনুযায়ী তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’

কোনও প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি অফিস থাকা সে দেশের জন্য গর্বের। এর অর্থ সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এ দেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বিশাল জনসংখ্যার দেশ তাদের কাছে আদর্শ। এখানে তারা তাদের বাজার বড় করতে চায়, বাজার ধরতে চায়। অন্যদিকে পরিবেশকদের দিয়ে সব কাজ হয় না। কারণ পরিবেশকরা একই সঙ্গে অনেক পণ্য নিয়ে কাজ করে, ফলে নির্দিষ্ট একটি পণ্যের প্রতি তেমন নজর দিতে পারে না।

প্রযুক্তিপণ্য ব্যবসায়ী জিয়াউল হক বলেন, বাজার আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে কিন্তু সে তুলনায় কম এমডিএফ। তিনি বলেন, এমডিএফের বড় একটা অংশ অনেক কোম্পানি মুনাফা হিসেবে আগে সরিয়ে রাখতো, এখনও রাখে। ফলে অবশিষ্ট অংশ দিয়ে বাজারে খুব বেশি কিছু করার থাকে না। এ কারণে প্রিন্সপাল অফিস বা উৎপাদকেরা এমডিএফ কমিয়ে দিয়েছে। প্রিন্সিপাল অফিস বা উৎপাদকরাও বিষয়টি জেনেছে। ফলে এখন প্রয়োজনেও আমরা তাদের কাছ থেকে বাজেট আনতে পারি না। আগের মতো মেলায় স্পন্সর হতে পারি না। মেলা আয়োজকরা আমাদের ওপর নাখোশ থাকেন, কেন দিতে পারছি না এজন্য। আদতে আমাদের দেওয়ার কোনও উপায় নেই। এটা তারাও ভালো করে জানেন। তারপরও তাগাদা দেন। ব্যবসায় থেকে টাকা নিয়ে তো এসব করতে পারি না। তবে অনেক সময় ঠেকে গিয়েও করতে হয়।

এদিকে কান্ট্রি অফিস রয়েছে হুয়াওয়েরও। এমএসআই, লজিটেক, এসার, লেনেভো ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে প্রতিনিধি। অ্যান্টিভাইরাস প্রতিষ্ঠান ক্যাস্পারস্কির রয়েছে প্রতিনিধি অফিস। অন্যদিকে কান্ট্রি অফিস রয়েছে মাইক্রোসফট, ওরাকল ইত্যাদি সফটওয়্যারের, যার সঙ্গে প্রযুক্তি পণ্যের নিবিড় সম্পর্ক।