• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

পরমাণুর সন্ধানে অভিযাত্রা!

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০১৮  

পরমাণুর ধারণাটি এসেছিল আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাসের কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন, এই কণাটিই পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা, অদৃশ্য এবং অবিভাজ্য। এরপর তাকে আর ভাঙা যাবে না, এটাই 'দি আল্টিমেট বিল্ডিং ব্লক অব ম্যাটার!'অতদিন আগে যখন তিনি পরমাণুর কথা বলেছিলেন তখন কি ভেবেছিলেন, বহুকাল স্তিমিত থাকার পর সেই ধারণাটিই আবার ফিরে আসবে, উত্তর জোগাবে অনেক অজানা প্রশ্নের? মনে হয় না, কিন্তু তিনি কি হঠাৎ করেই এই ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন? না, তা নয়।

তার প্রায় ২০০ বছর আগে থ্যালেস নামের এক দার্শনিক খুঁজছিলেন একটি প্রশ্নের উত্তর। এই বিশ্ব কী দিয়ে তৈরি এবং কীভাবে সেটি কাজ করে? এই প্রশ্ন থেকেই পদার্থের মৌলিক উপাদান খোঁজার যাত্রা শুরু হয়।থ্যালেস হয়তো প্রকৃতির নানা ঘটনা প্রবাহ নিয়ে ভেবেছিলেন, দেখেছিলেন জগৎ জুড়ে জন্ম-মৃত্যুর খেলা, সৃষ্টি-ধ্বংসের খেলা। মানুষ জন্ম নেয় ছোট থেকে বড় হয় একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এক সময় তার সাধের দেহটি মিশে যায় মাটির সঙ্গে, যেমন ফুল ফোটে আবার ঝরেও যায়। প্রাণীজগৎ আর বৃক্ষজগতেও একই ঘটনা।তাহলে কী এমন কিছুই নেই, যা স্থায়ী; যাকে এই জগতের পরিচয়চিহ্ন হিসেবে ভাবা যায়, যা কোনো অবস্থাতেই ধ্বংস হয়ে যায় না? তিনি ভেবে ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে,পানি হচ্ছে সেই মৌলিক উপাদান যার ধ্বংস নেই!

কেন তিনি এমনটি ভেবেছিলেন বোঝা মুশকিল।হয়তো নানা কারণ ছিল। প্রাণী ও বৃক্ষের জীবনধারণের জন্য পানি এক অপরিহার্য উপাদান, আবার বস্তু যে রূপেই থাকুক না কেন যথেষ্ট পরিমাণ তাপ দিলে তা থেকে পানিই বেরিয়ে আসে।এমনকি পানি একই সঙ্গে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় রূপে থাকতে পারে এবং যেহেতু পানির বিবিধ রূপ আছে হয়তো পানি থেকে মাটিরও সৃষ্টি হতে পারে। থ্যালেস কিছুটা ভাববাদী ছিলেন বোধ হয়।তিনি ভাবতেন এই জগৎটা পানির উপর ভাসছে, ভাবতেন চুম্বকের আত্মা আছে বলেই সে আকর্ষণ করতে পারে।যাহোক,থ্যালেসের এই প্রশ্নের উত্তরের চেয়ে স্বয়ং প্রশ্নটিই ছিল দারুণ জরুরি।

প্রশ্ন ছাড়া তো আর অনুসন্ধান হয় না! কিন্তু তার সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল।খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০ সালের দিকে তিনি এবং তার সহকর্মীরা মিলে একটা মতৈক্যে পৌঁছান, এই জগৎ কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কিত সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-তত্ত্বই হবে যুক্তিনির্ভর, অতীন্দ্রিয়ের উপর ভরসা করলে চলবে না। সত্যি কথা বলতে কী, এই ঘোষণাটিই বিজ্ঞানের জন্য দেয়। কারণ বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে থাকে যুক্তির উপর, অন্য কিছুতে তার আগ্রহ নেই।থ্যালেসের সমসাময়িক কালে জগতের মৌলিক উপাদান নিয়ে আরো কিছু মতামত এসেছিল। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দীর্ঘ পরিসর দরকার হবে, এই লেখায় সেদিকে যাওয়া হচ্ছে না।

এই যে আলোচনা, তারই ধারাবাহিকতায় ডেমোক্রিটাসের ধারণাটি প্রবর্তিত হয়।তিনি ভাবছিলেন, কোনো বস্তুকে যদি টুকরো টুকরো করে কাটতে থাকি তাহলে কতদূর পর্যন্ত কাটা যাবে? নিশ্চয়ই এমন একটি সময় আসবে যখন জগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছুরি দিয়েও আর কাটা যাবে না ওটাকে, মানে ওটাই তার শেষ স্তর। সেই শেষ সীমাকে তিনি বললেন অ্যাটম; বস্তুর অবিভাজ্য মৌলিক উপাদান।তার কল্পনাপ্রতিভা যে অসামান্য ছিল তা তো বোঝাই যায়, না হলে তখনকার সময়ে কেউ কি এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে ভাবতে পারে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার এই ধারণাটি প্রায় পরিত্যক্ত হয় প্রধানত অ্যারিস্টটলের কারণে। ডেমোক্রিটাসের পরমাণুর ধারনাটি অ্যারিস্টটল গ্রহণ তো করেন নি বরং হাস্যকর হিসেবে গণ্য করে একে পরিত্যাগ করেন এবং যেহেতু অ্যারিস্টটল সেই সময় প্রভাববিস্তারি দার্শনিক ছিলেন তাই পরমাণুতত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন আর চর্চাই হয়নি।

এরপর দু’হাজার বছরের বিরতি।উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজি রসায়নবিদ জন ডাল্টন আবার ধারণাটিকে ফিরিয়ে আনেন। তিনি বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া পরীক্ষা করছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, প্রতিটি পদার্থেরই কোনো মৌলিক উপাদান আছে। পরমাণুর ধারনা ফিরে এলেও ডাল্টন এর গঠন সম্পর্কে আর কিছু ভাবেননি।সেটি নিয়ে প্রথম কথা বলেন আরেক ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্যার জোসেফ জন থমসন। ১৮৯৭ সালে তিনি প্রথম পারমাণবিক কণা হিসেবে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। থমসন জানতে পেরেছিলেন, ইলেকট্রন ঋণাত্মক আধানবাহী কণা, কিন্তু সব বস্তুই আধান নিরপেক্ষ।

এই ধারণা থেকেই তিনি একটি পরমাণু মডেল উত্থাপন করেন, অনেকটা এরকম, 'একটা পরমাণু মূলত ধনাত্মক আধান দিয়ে তৈরি, যেখানে ইলেকট্রনগুলো পুঁতে রাখা আছে।' অনেকটা কেকের ভেতর কিসমিস পুঁতে রাখার মতো ব্যাপার। কেকটা ধনাত্মক আধানের, কিসমিসগুলো ঋণাত্মক আধানবাহী ইলেকট্রন বা ধানক্ষেতে ধানের চারা পুঁতে রাখার মত ব্যাপার। ক্ষেতটা ধনাত্মক, চারাগুলো ঋণাত্মক ইলেকট্রন। ইলেকট্রনের এই আবিষ্কারই আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের দরজা খুলে দেয়।

পরবর্তী পর্বে আমরা রাদারফোর্ড ও বোরের পরমাণু মডেল নিয়ে আরো বিস্তৃত আলোচনা করে পরমাণুর স্বরূপ সন্ধানের ইতিহাস জানবো।