• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে শিবচরের চরাঞ্চল রূপ নেবে আধুনিক নগরীতে

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯  

শিবচর প্রতিনিধি: ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ ও ৭২ ফুটের চারলেনের সড়ক নিয়ে পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে পদ্মাসেতু। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের এই সেতুকে ঘিরে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার পদ্মার চরাঞ্চলের মানুষের আবেগজড়িয়ে রয়েছে। পদ্মাসেতুর জন্য জমি হারাতে হয়েছে এই চরের মানুষের। হারাতে হয়েছে দীর্ঘদিনের বসতভিটা এমনকি কবরস্থানও। তবে অধিগ্রহণকৃত জমির জন্য সরকার প্রচুর অর্থ দিয়েছে। তারপরও এই পদ্মাসেতুকে ঘিরে বিশেষ করে এই অঞ্চলের মানুষের মনে ভিন্ন এক আবেগ কাজ করে। পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে মাদারীপুরের শিবচর ও শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবাসহ পদ্মার চরাঞ্চল রূপ  নেবে আধুনিক নগরীতে। এমন প্রত্যাশা চরের মানুষের। এছাড়া পদ্মাসেতু নির্মানের সাথে সাথেই চরাঞ্চলে নির্মান হচ্ছে যোগাযোগের জন্য সড়ক,নদী বা খালের উপর তৈরি হচ্ছে সেতু। সরকারি-বেসরকারীভাবে নির্মিত হচ্ছে নানা স্থাপনাও।

আর তাই চোখের সামনে ক্রমেই বড় হতে থাকা সেতুটি দেখে বয়স্করা আবেগতাড়িত হয়ে পরেন। পদ্মাসেতুর সাথে চরাঞ্চলের উন্নয়ন দেখে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি দেখতে পান পিছিয়ে পড়া চরাঞ্চলের তরুনেরা! পদ্মাসেতু নিয়ে শিবচরের চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ী, মাদবরেরচর ও সেতু সংলগ্ন এলাকার মানুষের সাথে আলাপ করলে এই ধারণা পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে পদ্মাসেতুর জন্য নির্মিতব্য ৪১ টি স্প্যান এর মধ্যে ৬টি স্প্যান বসানো হয়েছে সেতুর জাজিরা প্রান্তে। পদ্মাসেতু সংলগ্ন শিবচরের কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত ও শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, শিবচরের চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এই পদ্মাসেতুকে ঘিরে। এই প্রত্যাশা এ এলাকার খেটে খাওয়া মানুষের। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে শহরায়নে রূপ নেবে এই এলাকা। তৈরি হবে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার ফলে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে বৃদ্ধি পাবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। ‘খেটে খাওয়া মানুষ’ এই কথাটার আমুল পরিবর্তন হবে চরাঞ্চলে।

জানা গেছে, চরাঞ্চলের শিক্ষা ও অর্থনীতিতে পিছিয়ে পরা মানুষ এখনো জীবিকার জন্য পদ্মার উপর নির্ভর করে। অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আবার লঞ্চ, ফেরিতে ও ঘাট এলাকায় ‘হকারি’ করে জীবন ধারণ করে। তাছাড়া শিশুদের একটা অংশকে দেখা যায় কাঁঠালবাড়ী ঘাট এলাকায় ‘কুলিগিরী’ করতে। যাদের বাবা-মা ঘাটকেন্দ্রীক নানা পেশায় জড়িয়ে জীবনধারণ করছে।

এ ধরণের বেশ কয়েকটি পরিবারের সাথে কথা বললে তারা জানান,‘পদ্মাসেতুর সাথে সাথে এই এলাকায় নানা উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। এই চর আর চর থাকবে না। শহরের রুপ নেবে। আমাদেরও আয়-রোজগার বাড়বে। আমরা এই সুবিধা ভোগ করতে না পারলেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমাদের সন্তানেরা পদ্মাসেতুর সুবিধা ভোগ করবে। তাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে।’

কাঁঠালবাড়ী ঘাট সংলগ্ন এলাকা, কাঁঠালবাড়ী ও চরজানাজাত এলাকার অধিকাংশ প্রবীন ব্যক্তিরাই জানান, তাদের বড় স্বপ্ন ছিল পদ্মায় একটা সেতু! সেই স্বপ্ন এখন প্রায় বাস্তবায়নের পথে। আর এই সেতুকে ঘিরেই এ এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হবে এমনটা ধারনা অনেকেরই। পদ্মার পাড়সহ আশেপাশের এলাকায় শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে এ এলাকার সাধারন মানুষের একটা বড় ধরনের কর্মসংস্থান হবে। জীবনযাত্রার মান বাড়বে-এমন ধারনা এখন স্থানীয়দের মাঝে। আর সেই স্বপ্ন নিয়েই তৃপ্তির সাথে সকাল-বিকাল পদ্মাসেতু নির্মানের বিশাল আয়োজন দেখছেন এ এলাকার সাধারণ মানুষেরা।

পদ্মায় স্পিডবোট চালিয়ে জীবন ধারণ করেন প্রায় তিনশতাধিক পরিবার। পদ্মাসেতু হয়ে গেলে আর এই রুটে থাকছে না স্পিডবোট। বেকার হয়ে পরবে চালকেরা। তখন কী করবেন? এই প্রশ্ন করলে তারা বলেন,‘আমরা পদ্মাসেতুকে জন্মাতে দেখেছি। প্রতি নিয়ত দেখছি চোখের সামনে ক্রমান্বয়েই মাথা উচু করে দাঁড়াচ্ছে। পদ্মাসেতু আমাদের  গর্ব। হয়তো আর এই পেশায় থাকবো না। তবে পদ্মাসেতু হয়ে গেলে এই চরাঞ্চলে অসংখ্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান হবে। আমরা বেকার থাকবো না কেউই।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদ্মাসেতুকে ঘিরে মাদারীপুরের শিবচরের পদ্মার পাড় জুড়ে উন্নয়নের বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পদ্মার মাঝে জেগে উঠা প্রাচীন জনপদ ঘিরে রয়েছে নানা পরিকল্পনা। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ধারনা নিয়েই কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিরা পরিদর্শন করে যাচ্ছেন এসকল এলাকা। পদ্মার  চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, বিমানবন্দরসহ নানা উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা ইতোপূর্বে মাদারীপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য নূর-ই আলম চৌধুরী ও বিভিন্ন সময়ে শিবচরের আসা মন্ত্রিরা বলে গেছেন।

পদ্মাসেতু সংলগ্ন শিবচরের কুতুবপুর জাজিরার নাওডোবা এলাকায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তাঁত পল্লী গড়ে তোলা হবে। এ তাঁত পল্লীতে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ আধুনিক সকল সুযোগসুবিধা রাখা হবে। যার জন্য জমি অধিগ্রহণসহ বেশ কিছু কাজ এগিয়েছে। এ তাঁত পল্লীর জায়গায় অভৈধ স্থাপনাও সড়িয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
এছাড়াও পদ্মার পার কেন্দ্রীক আধুনিক শহর, ব্যবসাকেন্দ্র, পর্যটনকেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মানের পরিকল্পনাও পদ্মাসেতুর সাথে জুড়ে আছে।

সবকিছুই পদ্মাসেতু নির্মানকে কেন্দ্র করেই। আর এতে করেই সাজ সাজ রব এ এলাকাজুড়ে। তাদের স্বপ্ন এখন দৃশ্যমান। আর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের সাথে সাথে এ এলাকার উন্নয়ন, মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, এ সব কিছুই এখন সময়ের ব্যপার মাত্র। স্বপ্নের দৃশ্যমান দেখে এ এলাকার খেটে খাওয়া মানুষেরা বুনে যাচ্ছেন আরো স্বপ্ন, যার হাতছানি পদ্মার ঢেউতোলা জলে!

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে জাতীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ ভাগ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বছর ০.৮৪ ভাগ দারিদ্র নিরসনের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ১৫টি জেলার প্রায় ৫ কোটি মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে ৪২টি পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো। সেতুর ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২ নম্বর পিলারের ওপর ৫টি স্প্যান বসানোর মাধ্যমে জাজিরা প্রান্তে পৌনে ১ কিলোমিটার কাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। এছাড়া মাওয়া প্রান্তে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের স্প্যান (সুপার স্ট্রাকচার) ‘ওয়ান এফ’ আপাতত সেতুর ৪ ও ৫ নম্বর পিলারের ওপর রাখা হয়েছে।