• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

ঘুরে আসুন মৃত্যুকূপ চাঁদপুর ট্রায়াঙ্গেল

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ৫ অক্টোবর ২০১৯  

বিশাল ঘূর্ণিপাক। চারপাশ থেকে প্রবাহিত হচ্ছে তীব্র স্রোত। ভয়ঙ্কর ওই ঘূর্ণিপাকে কিছু পড়লে তার আর হদিস মেলে না। এমনকি বড় বড় যাত্রীবাহী লঞ্চও তলিয়ে গেছে এখানে, যেগুলোর সন্ধান কোনোদিনই আর পাওয়া যায়নি। বলছি চাঁদপুরের ত্রিনদীর সঙ্গমস্থলের কথা, যা স্থানীয়ভাবে কোরাইলার মুখ নামেও পরিচিত। 

পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া তিন নদী এসে মিলেছে এখানে। নদীগুলো তিনদিক থেকে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাওয়ায় সেখানে পানির বিশাল এক ঘূর্ণিগর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই ট্রায়াঙ্গেলে পড়েই নিখোঁজ হয়েছে শত শত মানুষ, লঞ্চসহ কার্গো কিংবা ট্রলার। তিন নদীর এ সঙ্গমস্থল যেন এক মৃত্যুকূপ।

মোহনাটি নদীর একেবারে তীরে অবস্থিত। সাধারণত নদীর তীর অগভীর থাকে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, নদীর তীরে হওয়া স্বত্ত্বেও এই মোহনা অনেক গভীর। বর্ষাকালে এটি রূপান্তরিত হয় মৃত্যুকূপে। পানির ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি দেখে মানুষের মনে শিহরণ জাগে। এই মোহনা নিয়ে লোকমুখে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। 

জনশ্রুতি আছে, এই মোহনা এক ছেলের অভিশাপে সৃষ্টি হয়েছে। সে হয়তো হাজার বছর আগের কথা। তখন মোহনাস্থলে কোনো নদী ছিল না। ছিল ছোটখাটো বাজার, হোটেল আর দোকানপাট। নদী ছিল কয়েক কিলোমিটার দূরে। একদিন বিকেলে ছোট এক দ্ররিদ্র ছেলে একটি হোটেলে গিয়ে খাবার চায়। হোটেলের মালিক তাকে তাড়িয়ে দেয়। ছেলেটি পুনরায় খাবার চাইতে গেলে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।

 

উত্তাল ঢেউ

উত্তাল ঢেউ

ছেলেটি আবারও ওই হোটেলে যায়। এবার হোটেলের লোকটি রেগেমেগে তার গায়ে গরম তেল ছুড়ে মারে। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাদঁতে কাঁদতে ছেলেটি চলে যায়। ওই রাতেই হোটেল অবধি কয়েক কিলোমিটার জায়গা নদীর অতলে হারিয়ে যায়। তৈরি হয় মোহনা। ওই ঘটনার বহু বছর পর ওই ঘূর্ণিপাকে পড়ে একটি লঞ্চ ডুবে যায়। তখন ডুবুরিরা লঞ্চের সন্ধানে নদীর তলদেশে গিয়ে দেখে একটি ছোট ছেলে চেয়ারে বসে আছে। ঘটনাগুলো আদৌ সত্যি কি-না তার কূল-কিনারা নেই। 

তবে অবাক করা বিষয় হলো একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে এই ঘূর্ণিপাকে। সেই অতীতকাল থেকে এখন পর্যন্ত এলাকাটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ও জাহাজ চলাচলের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারিভাবেও চাঁদপুরকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে মোহনার চারপাশে এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বৃত্তাকারে খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়। এখান দিয়েই প্রতিদিন চরাঞ্চলের বহু ট্রলার যাত্রী নিয়ে পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দেয়। 

চাঁদপুরে চার উপজেলায় প্রায় ৪০টি চরাঞ্চল রয়েছে। এসব এলাকার লোকজনকে দৈনন্দিন কাজ ও চিকিৎসার জন্য জেলা ও উপজেলা সদরে যেতে হয়। যোগাযোগের একমাত্র বাহন ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশু, নারী ও পুরুষ সবাই এসব ট্রলারে করে নিয়মিত জেলা সদরে যাতায়াত করেন। ফলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিয়মিতই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। 

চাঁদপুর জেলার বড়স্টেশন মোলহেডে ২৪ ঘণ্টাই প্রবল ঘূর্ণিস্রোত বইতে থাকে। প্রতি সপ্তাহে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে এখানে। এই তো গত ৩০ সেপ্টেম্বর মেঘনা-পদ্মা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ঘূর্ণন স্রোতের কবলে পড়ে নিখোঁজ হয় পাঁচ জেলে। জানা যায়, তিন নদীর মোহনায় ঘূর্ণন স্রোতে পড়ে জেলেদের নৌকাটি উল্টে যায়। এতে নৌকায় থাকা সাতজন জেলের মধ্যে দু’জন সাঁতরে পাড়ে আসতে সক্ষম হন। বাকি পাঁচজনকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। বলা যায়, ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছেন তারা। 

 

এভাবেই ঘূর্ণিগর্ত টেনে নেই নৌকাসহ জলজানগুলো

এভাবেই ঘূর্ণিগর্ত টেনে নেই নৌকাসহ জলজানগুলো

তবে অতীতের বেশিরভাগ ঘটনার চিত্র একেবারেই উল্টো। মালবোঝাই জাহাজ কিংবা কার্গো ডুবির মতো ঘটনা ঘটেছে এখানে। আর এসব দুর্ঘটনাজনিত জাহাজের সন্ধান কোনোদিনই আর পাওয়া যায়নি। মোহনায় এত বেশি স্রোত থাকে যে এসব নৌযান উদ্ধার কখনোই সম্ভব হয়নি। 

পূর্বের দুর্ঘটনার ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, পাকিস্তান আমল থেকে এখানে বহু যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে। যার মূল কারণ মোহনার তীব্র স্রোত। এখানে এমভি শাহজালাল, মদিনা, দিনার ও নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবে যায়। সবগুলো লঞ্চেই প্রচুর যাত্রী ছিল। তীব্র স্রোতের কারণে অধিকাংশ যাত্রীই বেঁচে ফিরতে পারেননি। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এমভি নাসরিন-১, যার প্রায় ৯০ ভাগ যাত্রীই মারা গেছে। এখন পর্যন্ত এখানে ডুবে যাওয়া কোনো লঞ্চের সন্ধান পায়নি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ - বিআইডব্লিউটিএ। 

মোলহেড ত্রিনদীর মোহনায় গিয়ে দেখা যায়, বর্ষার মৌসুম শেষ হলেও নদীর তীব্র স্রোত ও ঢেউ এখনো রয়েছে। আর এরই মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে মালামাল ও যাত্রী বোঝাই করে ট্রলারগুলো তাদের গন্তব্যস্থলে ছুটছে। প্রতিদিনই মালবোঝাই বড় বড় কার্গো কিংবা ট্রালার এ মোহনা পেরিয়ে চাঁদপুরের ব্যবসায়িক এলাকা পুরানবাজারে যায়। স্রোত বৃদ্ধি পেলে মালামাল নিয়ে নৌযানগুলো নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। 

স্থানীয় ব্যবসায়ী হাজী মো. সামছুল হক প্রধানীয়া বলেন, আমরা এখানে ১৯৬৯ সাল থেকে ব্যবসা করছি। সেই সময় থেকে দেখে এসেছি মোলহেড মোহনায় নদীর তীব্র স্রোত। এই স্রোতের কারণে মোলহেডের প্রায় আধা কিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখানে মাছের আড়ত, পাইলট হাউস ও দু’টি স্টিমারঘাট ছিল, যা নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। দিন যত যাচ্ছে, ঝুঁকি তত বাড়ছে। সবশেষ মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ২০০৩ সালের ৮ জুলাই এমভি নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবিতে মারা যান ১১০ জন, নিখোঁজ হন ১৯৯ জন।

 

তিন নদীর মোহনার পাড় কিন্তু অসম্ভব সৌন্দর্যমন্ডিত

তিন নদীর মোহনার পাড় কিন্তু অসম্ভব সৌন্দর্যমন্ডিত

ওই নৌ দুর্ঘটনায় লঞ্চটির মালিকও মারা যান। এরপর একই বছর চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক লঞ্চডুবিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৪০০ জনের তালিকা প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, দিন দিন স্রোতের তীব্রতা বাড়ার মূল কারণ বিপরীত পাশে চর জেগে ওঠা। স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারলে এখানে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। রাতে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এ মোহনা। প্রতিটি নৌযান এখান দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। 

শ্রমিক মো. আব্দুল করিম বলেন, আমি এখানে ছোটবেলা থেকেই কাজ করি। অসংখ্য দুর্ঘটনা নিজে দেখেছি। স্রোতের গতিপথ বুঝতে না পেরে অনেক নৌযান দুর্ঘটনার শিকার হয়। রাতে এখানে প্রচুর যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে। স্রোতের কারণে কখনো কখনো একটির আরেকটির সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। 

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কাউন্সিলর ফরিদা ইলিয়াস বলেন, মোহনায় দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। জেলে নৌকা, মালবোঝাই ট্রলার ও যাত্রীবাহী ট্রলার প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। আমরা এসব দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বদা কাজ করছি। যতদিন ডুবচর ও বিপরীত পাশের চরগুলো খনন করা না হবে, ততদিন এখানে স্রোত কমবে না। স্রোতের কারণে শহর রক্ষা বাঁধও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন হলে এখানে দুর্ঘটনা কমে আসবে। এদিকে বিপরীত পাশের চর জেগে ওঠায় পদ্মা নদীতে ইলিশ ঢুকতে পারছে না। এজন্য ইলিশ আহরণও হুমকিতে রয়েছে। 

 

লঞ্চের সঙ্গে ট্রলারের সংঘর্ষ

লঞ্চের সঙ্গে ট্রলারের সংঘর্ষ

চাঁদপুর নৌ থানার ওসি মো. আবু তাহের বলেন, মোহনাটিতে সবসময়ই প্রবল ঘূর্ণি স্রোত বয়ে যেতে থাকে। যার কারণে নৌযানগুলো দুর্ঘটানার শিকার হয়। এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করি। এছাড়া, ঝুঁকি কমাতে এ স্থানে সতর্কতা জারি করা হয়। 

সনাক (টিআইবি) চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি মোশারেফ হোসেন বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে যতটুকু সম্ভব মোহনাটি এড়িয়ে চলতে হবে। ঘূর্ণিস্রোতের অনেক দূর থেকে ডাকাতিয়ায় প্রবেশ করতে হবে। পানি যখন বাড়ে কিংবা বৃষ্টি হয়, তখন স্রোত আরো বেড়ে যায়। তখন স্রোতের এক কিলোমিটার দূর দিয়ে গেলেই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এছাড়া ঝূকিপূর্ণ স্থানে লাল সিগনাল দিয়ে রাখা উচিত, যাতে সবাই ওই স্থান এড়িয়ে চলতে পারে। 

চাঁদপুর নদীবন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বড়স্টেশন মোলহেডের মোহনাটি সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। এ স্থানটি যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত। আমরা বড় বড় মালবাহী জাহাজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছি, যাতে পাইলট নিয়ে জাহাজ চলায়। এছাড়া, এই মোহনার পাশ দিয়ে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ও জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, মোহনার পাশ দিয়ে বরিশাল, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চ চলাচল করে। তাদেরকে অবগত করা হয়েছে, ঘূর্ণিস্রোতের সময় কীভাবে এ স্থান অতিক্রম করতে হবে। তবে স্রোত পরিবর্তন কিংবা চর ড্রেজিংয়ের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কিছু জানানো হয়নি। 

 

স্থানটিতে পর্যটনের সমাগম চোখে পড়ার মত

স্থানটিতে পর্যটনের সমাগম চোখে পড়ার মত

তিন নদীর এ সঙ্গমস্থল চাঁদপুর জেলা সদরের অন্যতম একটি পর্যটন স্পট। প্রতিদিনই এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। 

যেভাবে যাবেন

বাস: পদ্মা এক্সক্লুসিভ (সায়েদাবাদ)। ভাড়া: ২৭০ টাকা। বাস সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রতি ৩০ মিনিট পরপর ছেড়ে যায়। 

লঞ্চ: ঢাকা সদরঘাট থেকে সকাল ৭.২০ মিনিট থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় লঞ্চ চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

ভাড়া: ডেকঃ ১০০ টাকা, চেয়ার: ১৫০ টাকা (নন-এসি), চেয়ার: ২৫০-২৮০ টাকা (এসি), কেবিন (সিঙ্গেল): ৪০০-৫০০ টাকা। 

চাঁদপুর ঘাট থেকে অটোতে ১০/১৫ টাকায় বড় স্টেশন, তিন নদীর মোহনা যাওয়া যেতে পারবেন। 

যেখানে থাকবেন

চাঁদপুর শহরে থাকার জন্য মোটামুটি মানের কিছু হোটেল রয়েছে। ভাই ভাই আবাসিক হোটেল, তালতলা বাসস্টেশন হোটেল সকিনা, নতুনবাজার। ভাড়া: হোটেলভেদে ৪০০-৬০০ টাকা

যা খাবেন

চাঁদপুর শহরে গেলে অবশ্যই বড় স্টেশন সংলগ্ন হোটেলে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাবেন। তিন-চারজন বা এরচেয়ে বড় গ্রুপ হলে রেলস্টেশনের পাশের ইলিশের বাজার থেকে আস্ত ইলিশ মাছ কিনে হোটেল থেকে রান্না করিয়ে নিতে পারেন। এতে খরচ কম পড়বে এবং খেয়েও মজা পাবেন। কালিবাড়ি মোড়ে ওয়ান মিনিট দোকানের আইসক্রিম বেশ বিখ্যাত। দাম ৪০ টাকা।