• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তিন দশক

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০২১  

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ৩০ বছরে পদার্পণ করছে আজ। ১৯৯২ সালের এদিনে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠন হয় এ সংগঠনের ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ৭২টি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি'।

এই কমিটির নেতৃত্বেই ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের লক্ষ্যে গণআদালত বসিয়ে প্রতীকী বিচার করা হয় গোলম আযমের। এ কমিটির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার চার দশক পর ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।

নির্মূল কমিটির কার্যক্রম বর্তমানে দেশের সব জেলা ও উপজেলার পাশাপাশি দেশ-বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, নরওয়ে, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই এখন সংগঠনটি গণহত্যা এবং ধর্মীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের পাশাপাশি বিচারের দাবিতে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।

নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে আমির ঘোষণা করা হয়। গোলম আযম তখনও পাকিস্তানি নাগরিক। কারণ বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে ৩৯ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল, সেটিতে তার নামও ছিল। প্রতিবেদনটি দেখে তখনই মুক্তিযুদ্ধের সাত নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান (প্রয়াত) আমাকে টেলিফোন করে বলেন, এর বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ করা দরকার। পরে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ১০১ সদস্যের একটি কমিটি (নির্মূল কমিটি) গঠন করা হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম।

সংগঠনের অর্জন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেই এই বিচার সম্পন্ন করা হচ্ছে। পৃথিবীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এটিই প্রথম ট্রাইব্যুনাল, যেটা সরকার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় গঠন করতে বাধ্য হয়েছে। এখন এ সংগঠন বিশ্বব্যাপী যে কোনো ধরনের গণহত্যা এবং ধর্মীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের পাশাপাশি বিচারের দাবিতে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠনের কার্যক্রম ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকবে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্য ও তাদের এদেশীয় দোসর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এ বিচারের উদ্যোগ নেয়। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি 'দালাল আইন' জারি হয়। পরে জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের ২১ জুলাই 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস' আইন পাস হয়। ওই আইনের আওতায় ২২ মাসে দুই হাজার ৮৪৮টি মামলা নিষ্পত্তি করে ৭২টি ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় ৭৫২ জনের। আর লঘু অপরাধে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পায় ২৬ হাজার যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করেন। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। ছাড়া পেয়ে যায় কারাগারে থাকা যুদ্ধাপরাধীরাও। কিন্তু ১৯৯১ সালে গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ঘোষণা করলে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ। শহীদ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

২০০৮ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয় এবং একই বছরের ৯ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনের কিছু সংশোধনী পাস করা হয়। ২০১০ সালে গঠন করা হয় 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল'। গত ১০ বছরে এই ট্রাইব্যুনালে বিচারের রায় হয়েছে ৪২টি মামলার। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ৮৭ জন। এর মধ্যে পলাতক রয়েছে ৪২ জন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ১০টি মামলা। চূড়ান্ত রায় অনুযায়ী এ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ছয় যুদ্ধাপরাধীর। এই যুদ্ধাপরাধীরা হলো- মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী), আব্দুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। অন্যদিকে বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে ফাঁসির পরিবর্তে ৯০ বছরের সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে কারাগারে মৃত্যু হয় তার।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন: একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে নাগরিক আন্দোলনের তিন দশক' শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে থাকছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এ ছাড়াও শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব, শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময় এবং সংগঠনের সর্বইউরোপীয় কমিটিসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য দেবেন।