• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

ঐতিহাসিক স্থান ‘সাবা’র ইতিহাস

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০১৮  

আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে রয়েছে অনেক স্থানের বিবরণ। কুরআন তার বর্ণনাভঙ্গিতে কখনো স্পষ্ট করে কখনো বা আকার ঈঙ্গিতে এসব স্থানের বর্ণনা দিয়েছে। ঈঙ্গিতপূর্ণ স্থানগুলোর বিবরণ আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে দিয়েছেন। আর হাদিসে না থাকলেও ঐতিহাসিকদের বিবরণে রয়েছে। সচেতন একজন কুরআনের পাঠকের জন্য ওই স্থান ও কালের বিবরণগুলো জানা জরুরি। فَأَعْرَضُوا فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ سَيْلَ الْعَرِمِ وَبَدَّلْنَاهُمْ بِجَنَّتَيْهِمْ جَنَّتَيْنِ ذَوَاتَيْ أُكُلٍ خَمْطٍ وَأَثْلٍ وَشَيْءٍ مِنْ سِدْرٍ قَلِيلٍতরজমা- `তা সত্ত্বেও তারা (হেদায়াত থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিল। ফলে আমি তাদের উপর বাঁধভাঙ্গা বন্যা ছেড়ে দিলাম এবং তাদের দু’পাশের বাগান দু’টিকে এমন দু’টি বাগান দ্বারা পরিবর্তিত করে দিলাম, যা ছিল বিস্বাদ ফল, ঝাউগাছও সামান্য কিছু কুল গাছ সম্বলিত। (সুরাতুস সাবা, আয়াত : ১৬) সাবা ও সাইলুল আরিম ভূমিকা উল্লিখিত আয়াতটি সুরাতুস সাবার ষোল নম্বর আয়াত।

এই সুরাতে ঐতিহাসিক সাবাদের আলোচনা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মধ্যে সাবা ও সাইলুল আরিমের ঘটনাও অত্যন্ত গুরুত্ব রাখে এবং বহু জাতির উত্থান ও পতনের ইতিহাসে শত-সহস্র শিক্ষা ও উপদেশের উপকরণ জুগিয়ে দেয়। জাতিসমূহের উত্থান ও পতনের পটভূমি অদৃষ্ট বা দৈব ক্রিয়ার অনুগ্রহের ফল নয়; বরং তা সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত মৌলনীতির ভিত্তিতেই রচিত হয়ে থাকে। অবশ্য কখনো কখনো উত্থান ও পতনের কারণগুলো এতটা স্পষ্ট ও পরিষ্কার হয়ে থাকে যে, সাধারণভাবে তা হয়তো চোখে দেখা যায় অথবা জ্ঞান-বুদ্ধির সামান্য মনোনিবেশেই চিনে নেয়া যায়। আবার কখনো কখনো উত্থান-পতনের উপস্থিতি এমনসব কার্যকারণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে যার সম্পর্ক সাধারণ কারণ ও উপকরণ থেকে ভিন্ন এবং আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ও অবাধ্যাচরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে একটি জাতির মধ্যে উন্নতি ও উৎকর্ষের কারণ ও উপকরণ বিদ্যমান থাকে, তারপরও ওই জাতি অকস্মাৎ ধ্বংস ও বিনাশের মুখে পতিত হয়। ফলে মানবজগতের জন্য ওই জাতির ধ্বংস বিস্ময়কর ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যখন তাদের অবাধ্যাচরণ ও বিদ্রোহ এবং আল্লাহর হুকুম-আহকামের অবিরাম লঙ্ঘন ও বিরুদ্ধবাদিতার ওপর থেকে পর্দা সরে যায় এবং আল্লাহর ওহি তাদের কৃতকর্ম ও পরিণামের সর্বসাধারণের সামনে উপস্থিত করে, তখন বুদ্ধিমান মানুষেরা বিশ্বাস করে নেন যে, ওই জাতির সামাজিক জীবনের চমৎকার খোলসের মধ্যে এমন নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত অবস্থা বিরাজমান ছিলো। অতএব, ওই জাতির ধ্বংস ও বিনাশ অদৃষ্ট বা দৈব ক্রিয়ার ফল নয়; বরং তা আল্লাহর বিধানাবলির ‘কৃতকর্মের পরিণাম-নীতি অনুসারেই ঘটছে।

সাবা ও সাবার সম্প্রদায়ের যে-শিক্ষণীয় পরিণাম এবং তাদের উত্থান-পতনের যে-উপদেশমূলক ঘটনা নিচে বর্ণনা করা হচ্ছে, তা জাতিসমূহের উত্থান ও পতনের দ্বিতীয় নীতি,‘কৃতকর্মের পরিণাম-নীতি’ অনুযায়ীই ঘটেছিলো। ইতিহাসের পাতাসমূহ এই সত্যের সাক্ষী রয়েছে যে, যে জাতি সচ্ছলতা ও বিলাসময় জীবনরে উঁচু স্তরে পৌঁছে নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্ত মনে জীবনযাপন করছিলো, তারা অকস্মাৎ ধ্বংস ও বিনাশের লাঞ্ছনাদায়ক গহ্বরে পতিত হয়েছে কেবল দৈব কারণ নয়; বরং তাদের অন্তহীন অপকর্মের এমন নিকৃষ্ট দিন তাদেরকে দেখতে হয়েছিলো। এখন সঙ্গত হবে কুরআন মাজিদ ওইসব বাস্তব ঘটনাকে যে-শৈলীতে বর্ণনা করে উপদেশ ও শিক্ষার উপকরণ প্রদান করেছে, ইতিহাসের নিখুঁত প্রমাণের মাধ্যমে তার বিবরণ উপস্থিত করা। যাতে কুরআন মাজিদের এই সত্যতার এই দিকটিও কুরআন অবিশ্বাসকারীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রমাণ হয়ে উঠে।

সাবা আল্লামা হিফজুর রহমান সিওহারবি রহ. রচিত কাসাসুল কুরআনে এ ব্যাপারে সুন্দর আলোচনা করেছেন। তার এই কাসাসুল কুরআনের বঙ্গানুবাদ করেছেন তরুণ আলেমেদ্বীন মাওলানা আব্দুস সাত্তার আইনি। তার অনুবাদ থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে প্রচুর। সাবা কাহতানি সম্প্রদায়গুলো একটি শাখাগোত্র। আরব ইতিহসিবিদগণ তার বংশ-পরস্পরা বর্ণনা করেছেন এভাবে: সাবা বিন ইয়াশযাব বিন ইয়া’রাব বিন কাহতান। কিন্তু তাওরাতে বলা হয়েছে যে, সাবা কাহতানের পুত্র। আর ইয়াকতান (কাহতান) থেকে জন্মগ্রহণ করে আহলুদাদ, সালাফ, হিসার, মাদাত, আরাখ, হাদওয়ারাম, আওযাল, ওয়াকলাহ উবাল, আবি মায়িল, সাবাহ, খাযারমাউত, আউকির, হাবিলাহ, ইয়ারিজ, ইয়ারাব ও ইউবাব। এরা সবাই ছিলো ইয়াকতানের বংশধর। মিসা থেকে সিফার যাওয়ার পথে এবং ইউরোপের পাহাড় পর্যন্ত তাদের আবাসভূতি বিস্তৃত ছিলো। যুবাইর বিন বাকার বলেন, আরবি ভাষায় কাহতান (قحطان) এবং হিব্রু ও সুরইয়ানি ভাষায় ইয়াকতান (يقطان) বা ইয়াকতান (يقطن) বলা হয়।

আধুনিক ইতিহাসবিদগণ তাওরাতের বর্ণনাকে সঠিক বলে মনে করেন। এ-কারণে কাহতানের বংশধর সম্পর্কে তাওরাতে যে-বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে তা ইতিহাসের বক্তব্যসমূহ ও শিলালিপির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আধুনিক ইতিহাসবিদগণের এই বিশ্লেষণ ছাড়াও আরো একটি বিষয় হলো, এ-ধরনের বিষয়ে তাওরাতের বর্ণনা বা ভাষ্যকে অন্যান্য ঐতিহাসিক বক্তব্যের মোকাবিলায় অধিক নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়। মোটকথা, তাওরাতের ভাষ্য অনুযায়ী সাবা কাহতানের পুত্র ছিলো এবং আরবদের বর্ণনা অনুসারে কাহতানে পৌত্র ছিলো। আর ইয়ারাব তাওরাতের বর্ণনা অনুসারে সাবার ভাই ছিলো আর আরবদের বক্তব্য অনুসারে কাহতানের পুত্র ছিলো। বংশবিদ্যায় অভিজ্ঞ ও ইতিহাসবিদগণ এ-ব্যাপারে একমত যে, কাহতান সম্প্রদায় সাম বিন নুহ আ.-এর বংশধরদের একটি শাখা। অবশ্য এ-ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে যে, তারা ‘আরবে আরিবা’র অংশ, না-কি ‘আরবে মুস্তারিবা’র অংশ, অর্থ্যাৎ হজরত ইসমাইল আ.-এর বংশধরদের অন্তর্ভূক্ত।

আদনানি ও কাহতানি কি একই বংশপরস্পরা, অথবা আদনানিরা তো ইসমাইল আ.-এর বংশধর আর কাহতানিরা তাদের থেকে ভিন্ন একটি প্রাচীন বংশপরম্বরাএ- ব্যাপারে মতবিরোধ থেকে গেছে।কোনো কোনো আরব ইতিহাসবিদের প্রবল মত এই যে, কাহতানি সম্প্রদায়গুলোও হজরত ইসমাইল আ.-এর বংশধর এবং আরবের যাবতীয় গোত্র হযরত ইসমাইল আ.-এর বংশ ছাড়া অন্য কোনো বংশ থেকে নয়। বংশবিদ্যায় অভিজ্ঞ আলেমগণের মধ্যে যুবাইর বিন বাক্কার ও মুহাম্মদ বিন ইসহাকের মত এটাই। আর ইমাম বুখারিও এই মত পোষণ করেছেন। এ-কারণে তিনি তাঁ সহিহুল বুখারিতে باب نسبة اليمن إلي إسماعيل শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ সংকলন করেছেন। এই অনুচ্ছেদে তিনি একটি হাদিস সংকলন করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বনি আসলামকে যাদেরকে খোযআর একটি শাখাগোত্র বলা হয় নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম বনি ইসমাইল বলেছেন; আর খোযআ হলো বনি আয্দের একটি শাখা এবং সর্বসম্মতিক্রমে বনি আয্দ হলো কাহতান বংশোদ্ভূত। অতএব, কাহতানিরা হযরত ইসমইল আ.-এর বংশোদ্ভূত। সহিহুল বুখারির হাদিসটি নিম্নরূপ- عَنْ سَلَمَةَ بْنَ الْأَكْوَعِ رَضِيَ الله عَنْهُ قَالَ مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّ اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ عَلَى نَفَرٍ مِنْ أَسْلَمَ يَنْتَضِلُوْنَ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ ارْمُوَا بَنِي إسْمَاعِيْلَ فَإِنَّ أَبَاكُمْ كَانَ رَامِيًا. “

হজরত সালামা বিন আকওয়া রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসলাম গোত্রের একটি দলের পাশ দিয়ে গেলেন। তখন তারা তীর ছোঁড়ার রেওয়াজ করছিলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাম তাদের বললেন, ‘হে বনি ইসমাইল, তোমরা তীর ছোঁড়ার অভ্যাস করো। কেননা, তোমাদের পিতা ইসমাইল আ. তীরন্দাজ ছিলেন। ‘আর ‘আহাদিসুল আম্বিয়া’ অধ্যায়ে হজরত ইবরাহিম আ.-এর কাহিনিতে হজরত হাজেরা রা.-এর উল্লেখ করে হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, تِلْكَ أُمُّكُمْ يَا بَنِيْ مَاءِ السَّمَاءِ “হে বনি মাউস্সামা, হাজেরাই হলেন তোমাদের আদি মাতা।’ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. এই বাক্যের ব্যাখ্যা লিখেছেন, “হজরত আবু হুরায়রা রা. আরবদেরকে بَنِيْ مَاءِ السَّمَاءِ বা ‘আকাশের পানির সন্তান’ বলেছেন এজন্য যে, তারা নিজেদের জন্য এবং তাদের এমনসব জায়াগায় তাঁবু ফেলতো যেখানে আকাশের পানি জমা হয়ে থাকতো। অথবা, আকাশের পানি দ্বারা এখানে যমযম উদ্দেশ্য।

এই দুটি অর্থের প্রেক্ষিতে এই বাক্য ওইসব ব্যক্তি জন্য দলিল হতে পারে যাঁরা বলেন যে, সমগ্র আরব জাতি হযরত ইসমাইল আ. এর বংশোদ্ভূত।”সাবা শব্দটি নাম না উপাধি? সাবা শব্দটি কারো নাম না কি উপাধি- এই প্রশ্নের জবাবও আমাদের আলোচ্য বিষয়। তাওরাতের বক্তব্য অনুযায়ী এটি নাম আর ইতিহাসবিদ বলেন সাবা হলো উপাধি আর নাম হলো আমর বা আবদে শাসম। সাবাদের শাসনকাল সাধারণ ইতিহাসবিদগণ বলেন সাবা চল্লিশ বছর শাসন করেছেন। তবে আধুনিক ইতিহাসদর্শনের প্রেক্ষিতে উল্লিখিত বাক্যের অর্থ মনে করা হয় যে, এতে সাবার বংশের শাসনকাল বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই নিয়ম এখানে সঠিক বলে মনে হচ্ছে না। কেননা, যদি কাহতাকনের তৃতীয়পুরুষ থেকে এই সময়সীমা শুরু করা হয়, তবে তা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৫০০ সাল হতে পারে। এই হিসেবে সাবার শাসনকাল খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে হয়ে যাওয়া উচিত।

সাবা ও শাসনকালের স্তরসমূহ ইতিহাসবদিগণ বলেন, সাবার দুইজন পুত্র ছিলো। একজনের নাম হিমইয়ার অন্য জনের নাম কাহলান। আরবে যত কাহতানী বংশ আছে সবাই এরা দুজনের বংশধর। ইতিহাসের সাবাদের শাসনস্তর দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগকে মাকারিবে সাবা উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয়, অন্যদেরকে মুলুকে সাবা। সাবাবাসীর আল্লাহর নাফরমানী সাবাবাসী একটা সময় পর্যন্ত তাদের নাজনেয়ামতের মাঝে থেকে আল্লাহর তায়ালার ইবাদত গোজারীর মধ্যে ছিল। চতুর্মুখী সুখ যখন তাদেরকে ভালোর পথ থেকে সরিয়ে মন্দের পথ দেখাতো; তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্ক করা হতো। তারা পুনরায় ভালো হয়ে যেতেন। এভাবেই একদিন তারা শিরক করে বসলো, বারবার সতর্ক করার পরও তারা সতর্কিত হয়নি। অতপর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দান করেন।