• বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন
ব্রেকিং:
নতুন বছর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে : প্রধানমন্ত্রী আ.লীগ ক্ষমতায় আসে জনগণকে দিতে, আর বিএনপি আসে নিতে: প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা রাষ্ট্রপতির দেশবাসী ও মুসলিম উম্মাহকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কিশোর অপরাধীদের মোকাবেলায় বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ব্রাজিলকে সরাসরি তৈরি পোশাক নেওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর জুলাইয়ে ব্রাজিল সফর করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী আদর্শ নাগরিক গড়তে প্রশংসনীয় কাজ করেছে স্কাউটস: প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় স্কাউট আন্দোলনকে বেগবান করার আহ্বান

আজ খুন করবেন না?

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২২ জুলাই ২০১৯  

একজনকে টেনেহিঁচড়ে গেট থেকে বের করে আনা হলো। এরপরই শুরু বেদম পিটুনি। সেই পিটুনির কোনো ব্যাকরণ নেই, যেমন খুশি তেমন মারো। আরে, মার দেওয়ার এমন মোক্ষম সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? আমরা হলাম ঝোপ বুঝে কোপ মারার মানুষ, সুযোগ পেলে আমরা ছাড়ি না। তাই একজন দু-একটা লাথি মেরেই অন্যকে জায়গা করে দিচ্ছিলেন। সেই অন্য ব্যক্তির দেওয়া সুযোগে আবার হাত-পায়ের সুখ করে নিচ্ছিলেন আরেকজন। একজন ভাবলেন, এভাবে সুখ জমছে না! তাই তিনি নিয়ে এলেন লাঠিজাতীয় কিছু। তাঁর দেখাদেখি আরেকজন। এভাবে চলতে থাকল ততক্ষণ, যতক্ষণ না জীবন্ত মানুষটি নিকেশ হন।

হ্যাঁ, এটি একটি সংঘবদ্ধ খুনের চিত্রনাট্য। ঠিক এভাবেই গত শনিবার এই ঢাকা শহরের অধিবাসীরা একটি খুন করেছেন। খুনের সময় ও খুনের পরে ক্যামেরা ছিল অসংখ্য। একটি স্বতঃস্ফূর্ত খুনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এসব ক্যামেরায় রেকর্ড হয়েছে। কেউ কেউ আবার গণপিটুনিতে নির্জীব মানুষটির ছবিও তুলছিলেন ক্যামেরায়। আহা, তাতেও কী কাড়াকাড়ি! আচ্ছা, ওই ছবিগুলো যাঁরা তুলছিলেন, তাঁরা কি বাড়ি ফিরে পরিবারের সদস্যদের তা দেখিয়েছেন? দেখিয়ে কী বলেছেন? 
‘এই দেখো, আজ আমি খুন করেছি!’

শনিবার সকালে বাড্ডার একটি স্কুলে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাসলিমা বেগমকে। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ওই স্কুলে নিজের চার বছরের মেয়েকে ভর্তি করানোর জন্য খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা। এ সময় স্কুলের গেটে তাঁর পরিচয় জানতে চান সেখানে থাকা কয়েকজন অভিভাবক। পরে তাঁকে প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে নিয়ে গেলে কে বা কারা এলাকায় ছড়িয়ে দেন স্কুলে একজন ছেলেধরাকে আটক করা হয়েছে। এরপর স্থানীয় কয়েক শ মানুষ তাসলিমাকে টেনেহিঁচড়ে এনে পেটাতে শুরু করেন। পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

তাসলিমাকে পেটানো হয়েছে প্রবল ক্ষোভে। সেই ক্রোধের আগুনকে লেলিহান বানিয়েছে ‘ছেলেধরা’ নামের একটি শব্দ। আর তাতেই আমরা সবাই হত্যার মতো একটি গর্হিত ও নিষ্ঠুর কাজের লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। বেরিয়ে পড়ল আমাদের জান্তব রূপ। বিজ্ঞানের ভাষায় মানুষও জন্তু। তফাত শুধু বিবেক-বুদ্ধিতে। তবে এই জনপদে বিবেক বেশির ভাগ সময় নাটক-সিনেমায় থাকে। আর আমরা সযত্নে লালন করি ভেতরের শ্বাপদ সত্তা। উপযুক্ত বারুদে তা জেগে ওঠে বটে, তবে গর্জন করে সুবিধা বুঝে। নিজেদের চেয়ে অসহায় কাউকে পেলেই আমরা তা উগরে দিই। অন্যের রক্তে হাত রাঙানো তখন মামুলি ব্যাপার।

শনিবারের হত্যাকারীদের কাছে জিজ্ঞাসা, পেটানোর মুহূর্তে কি নিজেদের মা-বোনের কথা মনে পড়েছিল? অথবা নিজের মেয়ের মুখ কি ভেসে উঠেছিল মনের পর্দায়?

ওহ, সরি সরি। আমি খুব দুঃখিত, ভুল প্রশ্ন করেছি বলে। আমি কাদের কী জিজ্ঞেস করছি! যাঁরা ফেসবুকে খুনের মেমেন্টো আপলোড দিতে দিতে এই যুগেও ভাবেন যে সেতু বানাতে শিশুর মাথা লাগে, তাদের কাছে এই প্রশ্ন করাই মূর্খতার শামিল। যাঁরা গুজবে কান দেওয়ার পাশাপাশি নিজের পুরো মাথাই দিয়ে বসে আছেন, তাঁদের কি আর মাথা খাটানোর পরামর্শ দেওয়া যায়?

তালিকায় তাসলিমা একা নন; আছেন আরও অনেকে। ঢাকার কেরানীগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে আহত এক ব্যক্তি (৪০) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রোববার রাতে মারা গেছেন। আরও হয়তো অনেকে নামে-বেনামে এই তালিকায় যুক্ত হবেন। তালিকা লম্বা হবে। একদিন আমরা সগর্বে বলব, ‘দেখে নাও, এঁদের হত্যায় আমরাও ছিলাম।’

শেষটায় কবি বিনয় মজুমদারের ওপর ভর করছি। তিনি লিখেছিলেন,

‘...উষ্ণ, ক্ষিপ্ত বাতাসেরা, মেদুর মেঘেরা চিরকাল
ঊর্ধ্বমুখী; অবয়বে অমেয় আকাঙ্ক্ষা তুলে নিয়ে
ঘুরেছি অনেক কাল পর্বতের আশ্রয় সন্ধানে;
পাইন অরণ্যে, শ্বেত তুষারে-তুষারে লীলায়িত
হতে চেয়ে দেখি কারো হৃদয়ে জীবন নেই; তাই
জলের মতোন বয়ে চ’লে যাবো ক্রমশ নিচুতে।’ (ফিরে এসো, চাকা)

আমরা নিচেই নামছি। তা নিয়ে আর না ভেবে বরং মেপে ফেলুন কতটুকু নিচে নামলেন। ওটাই ট্রফি।