• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

বাংলাদেশের প্রথম ‘গণভোট’: জনগণের সঙ্গে প্রতারণা

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২৩  

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচনে অনেক দল অংশ নিলেও, ঘুরে ফিরে ক্ষমতায় এসেছে মূলত ৩টি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৫ বার, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৪ বার এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ২ বার সরকার গঠন করেছে।

আওয়ামী লীগ প্রথম, সপ্তম, নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। বিএনপি দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনে এবং জাতীয় পার্টি তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। প্রতিটি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর করে হলেও ১১টি নির্বাচনের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ৫টিতে সংসদ তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি।

বাংলাদেশে ভোট ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ কীভাবে এবং মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার বিষয়টি কবে থেকে শুরু হলো? দেখা যাক পেছন ফিরে-

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাসদ, গণবাহিনী ও পাকিস্তান-মার্কিন গোপন জোটের সহায়তায় জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে প্রথমে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে ঘোষণা দেন। পরে আইনি জটিলতা দেখা দিলে, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা দিয়ে নিজে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং আবু সাদত মো. সায়েমকে করেন কাঠের পুতুলের রাষ্ট্রপতি। মূলচালিকা শক্তি হন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি আবু সাদত মো. সায়েমকে হটিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।

এর প্রায় দেড় বছর পর ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জেনারেল জিয়া তার শাসনকে বেসামরিক করতে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তার রাষ্ট্রপতি নিয়োগকে বৈধ করার জন্য গণভোট বা আস্থা ভোটের আয়োজন করেন। ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ২ শতাংশের নিচে, কিন্তু দেখানো হয় ৮৮ শতাংশ। জিয়ার পক্ষে দেখানো হয় প্রদত্ত ভোটের ৯৮ শতাংশ। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে।

‘হ্যাঁ‘ ভোটের বাক্স ভরেছিল ভোটগ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসাররা। বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্টের ২৯২ ও ২৯৩ বিধিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য তার চাকরির মেয়াদ শেষ না হলে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। কিন্তু চাকরিরত অবস্থায় জেনারেল জিয়া প্রার্থী হয়েছিলেন।

তিনি একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদে থেকে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেন। শেষ মুহূর্তের প্রচার প্রচারণা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন বাদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিরোধী দল সময় পায় ৪০ দিন। প্রচারের সময় দেয়া হয় ২০ দিন। জিয়া প্রচারে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ও হেলিকপ্টারসহ সব ধরনের যানবাহন ব্যবহার করে। বিরোধী প্রার্থীদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে জিয়ার পক্ষে একচেটিয়া প্রচারণা চালানো হয়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ ১৯৭৮ অনুযায়ী, কোনো সরকারি চাকরিজীবী ও সরকারি বেতনগ্রহীতার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হবার সুযোগ ছিল না। কিন্তু জিয়া আইন ভঙ্গ করে জোরপূর্বক রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হলে আর্মি, পুলিশ ও সরকারি চাকরিজীবীরা ন্যক্কারজনকভাবে জিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে। প্রকাশ্য ও গোপন কারচুপির মাধ্যমে জিয়া বিজয়ী হন।

১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর '৭২ সালে প্রবর্তিত দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন। ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ফেরত পাবার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলেন। জেনারেল জিয়া সেকেন্ড প্রক্লামেশন জারির মাধ্যমে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে দালালদের ভোটার হবার সুযোগ দেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতার কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দল, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিবি ও নেজামে ইসলামের জন্য ১৯৭৭ সালের ১ নং প্রক্লামেশন জারি করে সংবিধানের কিছু অংশ তুলে দেয়া হয়। এ সময়েই সামরিক আদালতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষশক্তি দমনের কাজ পুরোমাত্রায় চলমান ছিল।

১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া এক ফরমান জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে সব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নামে নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন।

১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। জিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও দুর্নীতি হয়। বিএনপির গুণ্ডা বাহিনী ঢালাও হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তাদের। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিবি এবং নেজামে ইসলামের যুদ্ধাপরাধীদের সমন্বয়ে গড়া সম্পূর্ণ নতুন জোট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগকে দেয়া হয় ২০টি আসন। ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যু’র মাধ্যমে জিয়া নিজের দল বিএনপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ২০৭টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করে। বিএনপির মনোনয়নে বিপুল সংখ্যক দালাল ও স্বাধীনতা বিরোধীকে বিজয়ী করে জাতীয় সংসদে আনা হয়।

১৯৮১ সালের ৩০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ৮২’এর ২৪ মার্চ সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ৮৩ এর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তিনি দেশ শাসন করেন। এদিনই রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ এফ এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিজের অধিকারে নেন।

এরশাদ দেশে প্রথম উপজেলা পদ্ধতি চালু করে ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন দেন। আগের সামরিক শাসকের মতোই জনসমর্থন পেতে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় পার্টি।

১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেন তিনি। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে বিজয়ী হয়। আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ৭৬টি আসনে। এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্দেহ এবং কারচুপির অভিযোগ ওঠে।