• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করলে মিয়ানমারকে একঘরে করার প্রস্তাব

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০২২  

পাঁচ দফা শান্তি পরিকল্পনার অগ্রগতির জন্য মিয়ানমারকে ‘পরিমাপযোগ্য সূচক’ ও একটি ‘নির্দিষ্ট সময়সীমা’ মেনে চলতে হবে। অন্যথা তাদের ‘একঘরে’ করা হবে। চলতি মাসের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমার সংকট নিয়ে এমন হুঁশিয়ারি দেন নেতারা।

চলতি মাসে এশিয়ায় পরপর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। টানা ১২ দিনের সম্মেলন ঘিরে রীতিমতো আন্তর্জাতিক ক্ষমতার রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। সম্মেলন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের তাবড় তাবড় নেতা ছুটে আসেন এ অঞ্চলে। প্রভাব বিস্তার ও নতুন নতুন অংশীদারিত্ব গড়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন ‘বড় খেলোয়াড়রা’। পিছিয়ে ছিল না ইউক্রেন অভিযানের কারণে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রাশিয়াও।

প্রথম সম্মেলনটি হলো অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান ন্যাশনস তথা আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন যা কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে ৮ নভেম্বর শুরু হয়ে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলে। এরপর ১৫ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার বালিতে বসে ‘গ্রুপ অব টুয়েন্টি’ তথা জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। সবশেষ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দুদিনব্যাপী এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন তথা এপেক শীর্ষ সম্মেলন যা শেষ হয় গত শনিবার (১৯ নভেম্বর)।

সম্মেলনগুলোর প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক গভীর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলা করা। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্ব ও উত্তর কোরিয়ার আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ থেকে সৃষ্টি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির চরম উত্তেজনায় সেই উদ্দেশ্য অনেকটাই ঢাকা পড়েছে।

তবে ১০ দিন ধরে চলা এই তিন সম্মেলন একেবারেই বিফলে যায়নি বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। অনেকেই বলছেন, সম্মেলনগুলোর মধ্যদিয়ে কয়েকটা ইস্যুতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান উত্তেজনার কিছুটা প্রশমন হয়েছে। এ ছাড়া দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক কূটনীতির পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত ৮ নভেম্বর কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে শুরু হয় ছয় দিনব্যাপী আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন। আসিয়ান হচ্ছে একটি অর্থনৈতিক সংগঠন, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত। আসিয়ানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা। সেই সঙ্গে সামাজিক অগ্রগতি, সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধন করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও জাতিসংঘের সনদের নীতি অনুযায়ী, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর নেতারা অংশ নেন। পাশাপাশি এ সম্মেলনে অংশ নেয় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিরাও।

সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের মতো নেতৃত্বের উপস্থিতি সম্মেলনের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে। এবারের আসিয়ান সম্মেলনে নেতাদের প্রধান ফোকাস ছিল মিয়ানমার সংকট। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, তাইওয়ান ঘিরে আঞ্চলিক উদ্বেগ, দক্ষিণ চীন সাগর ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে।

সম্মেলনের প্রথম দিনই মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন আসিয়ান নেতারা। তারা বলেন, মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নিরাপত্তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে আছে। দ্রুত শান্তিপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন না করলে মিয়ানমারকে একঘরে করারও হুমকি দেন তারা।

আসিয়ান সম্মেলনের দুদিন পরই ইন্দোনেশিয়ার পর্যটনখ্যাত দ্বীপাঞ্চল বালিতে অনুষ্ঠিত হয় দুদিনব্যাপী জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। ১৫-১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলন মূলত সামরিক পরাশক্তি, শিল্পসমৃদ্ধ ধনিক-বণিক দেশগুলোর নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন।

এই সম্মেলনে সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত ও অন্যরা বিভিন্ন কৌশলে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে। বিশ্ববাণিজ্য, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে।
সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো যখন বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি ও সম্ভাব্য বিশ্বমন্দা রোধকল্পে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে আকুল আহ্বান জানাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তখন তাইওয়ান, ইন্দোপ্যাসিফিক বাণিজ্য পথ, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের নিরাপত্তা বিধান নিয়ে সোচ্চার থেকেছে।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসান বা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও জোর আলোচনা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ থামানো নিয়ে দুইদিনের শীর্ষ সম্মেলনে কাঙ্ক্ষিত আলোচনা হলেও তা থামানোর ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া কিংবা কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়নি।

বিশ্ববাণিজ্যের প্রসার কিংবা সম্ভাব্য বিশ্বমন্দা রোধে সম্মিলিতভাবে তেমন কোনো ব্যবস্থা চালুর নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত তিন ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক সম্মেলনে যোগদানকারী অন্য সদস্য দেশগুলো কিংবা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়। সেটিই এবারের শীর্ষ সম্মেলনের একমাত্র সাফল্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

জি-২০ সম্মেলনের দুদিন পরই (১৮ নভেম্বর) শুরু হয় ২৯তম এশিয়া-প্যাসিফিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন বা এপেক শীর্ষ সম্মেলন। জি-২০-এর মতোই থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনও ছিল বিশ্বনেতাদের মিলনমেলা।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন ও রাশিয়াসহ ২১ সদস্য বিশিষ্ট আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংগঠনটি ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করে। বিশ্বের প্রায় ৩৮ শতাংশ জনসংখ্যা এপেকভুক্ত দেশগুলোতে বাস করে। এ ছাড়া বিশ্বের অর্ধেকের বেশি জিডিপি (৬২ শতাংশ) ও ৪৮ শতাংশ বাণিজ্যই এ দেশগুলো নিয়ন্ত্রণ করে।

এবারের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস। উপস্থিত ছিলেন খোদ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধি ছাড়াও অংশ নেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও সৌদি প্রধানমন্ত্রী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

সম্মেলনের প্রথম দিন ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে দেয়া লিখিত বক্তব্যে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল কারও নিজের বাড়ির ওঠান কিংবা পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নয়। ‘ন্যায়সংগত বিশ্বব্যবস্থা’ গড়ার আহ্বানও জানান তিনি।

একই সভায় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস বলেন, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বড় অংশীদারি’ রয়েছে। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির বড় চালক’ হিসেবে অভিহিত করেন।

সম্মেলনের একটি বড় জায়গা দখল করে নেয় উত্তর কোরিয়ার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টি। মিত্রদের পাশে নিয়ে এ ঘটনার নিন্দা জানান কামালা হ্যারিস।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেন, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কড়া প্রতিবাদ জানায় টোকিও। এ সময় তার পাশে দাঁড়িয়ে সুর মেলান অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের নেতারা। সম্মেলনে ‘এপেক ঘোষণা’সহ দুটি দলিল গৃহীত হয়।

সম্মেলনগুলো সামনে করে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রশ্নটা হচ্ছে, সদস্য দেশগুলোর নেতারা কি শেষ পর্যন্ত সম্মতিক্রমে একটা যৌথ ঘোষণায় পৌঁছাতে পারবেন? কম্পিউটার চিপের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি পণ্য থেকে শুরু করে তাইওয়ান সংকট ও ইউক্রেন সংঘাতের মতো বিভিন্ন ইস্যুতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা চলছিল।

তবে পরপর তিন সম্মেলনের মধ্যদিয়ে উভয়পক্ষ সেই উত্তেজনা ও অনৈক্য অনেকটাই কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংহতি বাড়াতে যৌথ ঘোষণায় সম্মত হয়েছে। যেমনটা বলছেন, ব্রুকলিন ইনস্টিটিউশনের সেন্টার ফর ইস্ট এশিয়া পলিসি স্টাডিজের পরিচালক মিরেয়া সোলিস।

তিনি বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও উভয় পক্ষের নেতারা উত্তেজনা অনেকটা কমিয়ে এনেছেন এবং দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে কার্যকর ও উন্মুক্ত যোগাযোগ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছেন।

মিয়ানমারের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকট ছিল আসিয়ান সম্মেলনের অগ্রাধিকার। মিয়ানমার জান্তা সরকার যদিও ছয়দিনের সম্মেলনে ইউক্রেন সংঘাতের চেয়ে কম মনোযোগ পেয়েছে। মিয়ানমার আসিয়ানের সদস্য দেশ। তবে গত বছর গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর প্রতিশ্রুত পাঁচ দফা শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠানো থেকে তাদের বিরত রাখা হয়।

সম্মেলনে আসিয়ান নেতারা একমত হয়েছেন যে, পাঁচ দফা শান্তি পরিকল্পনার অগ্রগতির জন্য মিয়ানমারকে ‘পরিমাপযোগ্য সূচক’ ও একটি ‘নির্দিষ্ট সময়সীমা’ মেনে চলতে হবে। অন্যথা তাদের ‘একঘরে’ করা হবে।

আসিয়ান নেতাদের এ কঠোর হুঁশিয়ারির পরপরই গত সপ্তাহেই সাধারণ ক্ষমার অংশ হিসেবে সাবেক ব্রিটিশ কূটনীতিক, এক অস্ট্রেলীয় অর্থনীতিবিদ, এক জাপানি সাংবাদিক ও অং সান সুচির সাবেক উপদেষ্টাসহ ৬ হাজারের বেশি রাজবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে মিয়ানমার সামরিক সরকার। জান্তার এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, ‘বিশাল সংখ্যক রাজবন্দি মুক্তি অন্ধকারে আশার আলো দেখাচ্ছে।’