• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

গ্লুকোমা কী? লক্ষণ, ধরন ও চিকিৎসা

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১৩ মার্চ ২০২৩  

গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ। এই রোগকে নিরব ঘাতক বলা হয়। এর কারণে চোখের দৃষ্টি একবার হারিয়ে গেলে তা আর ফেরত আসে না। গ্লুকোমার সর্বশেষ পরিণতি চিরতরে অন্ধ হওয়া। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যদি এই রোগ ধরা পড়ে, তবে সেই আশঙ্কা নেই বললেই চলে। এমন অনেক রোগীও আসেন, যাদের গ্লুকোমার কারণে ৯৯ শতাংশ দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থায় চিকিৎসকের কিছুই করার থাকে না। কিন্তু তিনি যদি এক ভাগ গ্লুকোমা নিয়ে আসতেন, তবে বলা যেতে পারে তিনি অন্ধ হবেন না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন গ্লুকোমা ফ্যাকাল্টি বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান, অধ্যাপক ডা. এম নজরুল ইসলাম।
গ্লুকোমা কী?

চোখের ভেতর অনেকগুলো নার্ভ রয়েছে। এর ভেতর প্রায় ১২ লাখ নার্ভ বা গ্যাংলিয়ন সেল থাকে। এই সেলগুলোর কাজ হচ্ছে দেখা। ১২ লাখ নার্ভ যখন ঠিক থাকে তখন আমাদের দৃষ্টিশক্তি ঠিক থাকে। সাধারণত কোনো কারণে চোখের প্রেসার বেড়ে গেলে নার্ভগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপটিক নার্ভের মাধ্যমে সংকেত ব্রেনে চলে যায়। তখন আমরা দেখতে পাই।

দেহে রক্ত সঞ্চালনের মতো চোখের মধ্যেও পানির এক ধরনের সরবরাহ হয়, যাকে বলে ‘অ্যাকুয়াস হিউমার’। এই পানি তৈরি হয় চোখের পাশ থেকে। এরপর চোখের ভেতর প্রবেশ করে চোখের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা মেটায়। একপর্যায়ে পানি বেরিয়েও যায়। এই জলীয় পদার্থের গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। চোখের কর্নিয়া, লেন্স, ভিট্রিয়াসে কোনো রক্ত সরবরাহ নেই বলে দেখার জন্য এগুলো স্বচ্ছ থাকতে হয়।

চোখের মধ্যে একটি কোণ দিয়ে এই জলীয় পদার্থটি বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোনো কারণে যদি কোণটি বাধাপ্রাপ্ত হয় বা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে চোখের মধ্যে প্রেসার বাড়তে থাকে। বেশি বেড়ে গেলে অপটিক নার্ভের মধ্যে কাঁপিং শুরু হয়; গর্ত হয়ে যায়।

গর্ত হওয়ার মানে হলো অনেক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। নার্ভের কাজ তখন ব্যাহত হয়। তখন রোগীর দৃষ্টির পরিসীমা কমে যায়। ধীরে ধীরে রোগী তখন অন্ধ হয়ে যায়।

সাধারণভাবে বলা যায় চোখের মধ্যে যে প্রেসার সেটা বেড়ে চোখের নার্ভের ক্ষতি হয়। এতে করে অপটিক নার্ভের যে ফাইবার রয়েছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ব্রেনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ব্যাহত হয়। যার কারণে রোগী আর দেখতে পায় না। এ রোগের নামই গ্লুকোমা।

ধরন: গ্লুকোমার কয়েকটি ভাগ রয়েছে। ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা, ক্লোজড অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা, সেকেন্ডারি গ্লুকোমা, প্রাইমারি গ্লুকোমা ইত্যাদি। তবে ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার রোগীই পৃথিবীতে বেশি। ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার কিছু লক্ষণ থাকে। তবে তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। যেমন— মাথাব্যথা করা, চশমা নেওয়ার পর দুই মাসের মধ্যেই আবার চোখে সমস্যা দেখা দেয়, ঘনঘন চশমা পরিবর্তন ইত্যাদি। ক্লোজড অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার কিছু লক্ষণ হলো লাইটের চারপাশে বিভিন্ন রং দেখা, অন্ধকার জায়গায় কাজ করতে সমস্যা হওয়া ইত্যাদি।

চিকিৎসা না করালে অ্যাকুড গ্লুকোমা হয়। তখন খুব মাথাব্যথা হয়। রোগী ব্যথায় মাটিতে গড়াগড়ি করতে থাকেন, বমিও করেন অনেকে। পাশাপাশি চোখ লাল হয়, ব্যথা করে, ফুলে যায়, বেশি আলোতে সমস্যা হয়। এ অবস্থায় চোখের দৃষ্টিশক্তি শূন্যে নেমে আসতে পারে।

কাদের ঝুঁকি বেশি?

গ্লুকোমা সবার হয় না। ৪০ বছর বয়সের পর গ্লুকোমার হার সবচেয়ে বেশি। বয়স যত বাড়বে গ্লুকোমা হওয়ার প্রবণতা তত বাড়বে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদেরও গ্লুকোমা হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যাদের চোখে মাইনাস পাওয়ার তাদেরও হতে পারে। তবে বংশগত গ্লুকোমা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারো যদি গ্লুকোমা হয় তার সন্তানদেরও গ্লুকোমা হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। এ জন্য তাদের সন্তানদের খুব দ্রুত গ্লুকোমা পরীক্ষা করা উচিত।

চিকিৎসা

রোগটি শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসা নিলে সারা জীবন ভালো থাকা যায়। শুরুতে চিকিৎসা করালে যেটুকু চোখ ভালো আছে তা ধরে রাখা যায়। তাই গ্লুকোমার প্রধান চিকিৎসা হলো চোখের প্রেসার কমানো। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তিনভাবে গ্লুকোমার চিকিৎসা করা হয়। প্রথম চোখের ড্রপ যেটা চোখের প্রেসার কমায়। দ্বিতীয়ত, লেজার, এটাও চোখের প্রেসার কমায়। তৃতীয়ত, সার্জারি যা চোখের প্রেসার কমানোর জন্যই করা হয়। তিন ধরনের চিকিৎসার একটাই উদ্দেশ্য- চোখের প্রেসার কমানো। আশার কথা যে বাংলাদেশে গ্লুকোমার সব ধরনের ওষুধ এবং আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা রয়েছে।

আধুনিক শল্যচিকিৎসা

ওষুধ ও লেজার প্রয়োগ করেও কাজ না হলে তখন সার্জারি বা শল্য চিকিৎসার কথা ভাবতে হয়। এ রকম প্রচলিত একটি চিকিৎসা ‘ট্রাবেকুলেক্টমি’। গ্লুকোমার চিকিৎসায় এটি সারা বিশ্বে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে। এটি একটি বাইপাস সার্জারি।

হার্টে ব্লক হলে রক্ত চলাচলে যেমন ব্যাঘাত ঘটে, তেমনি চোখের ভেতরের তরল পদার্থ বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হলে চোখের চাপ বাড়তে থাকে। এ জন্য তখন একটি বাইপাস করে দিতে হয়, যাতে তরলটি বেরিয়ে গিয়ে রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এতে চোখের ভেতরে চাপ কমে।

আবার ট্রাবেকুলেক্টমি সফল না হলে চোখের পাশে ভাল্ভ প্রতিস্থাপন করা হয়, যা আমরা বাংলাদেশে করছি। এর সফলতা অনেক বেশি। তবে গ্লুকোমার আরো উন্নত চিকিৎসা যেমন আই স্ট্যান্ট ইমপ্ল্যান্ট, কেবিডি সার্জারি ইত্যাদি আমরা করতে পারলেও আমাদের দেশে হচ্ছে না।

প্রতিরোধে করণীয়

> সচেতন হয়ে প্র্রত্যেকের বছরে অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া যে কারোর গ্লুকোমা হয়েছে কি না। শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা।

> গ্লুকোমা রোগটি সাধারণত ৩৫ বছরের পর শুরু হয়। তাই পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের নিয়মিত চেকআপ করা।

> গ্লুকোমা শনাক্ত হলে প্রতি তিন মাস অন্তর চোখ পরীক্ষা করা উচিত।

> চিকিৎসকের পরামর্শে নির্ধারিত মাত্রার ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শিশুদের স্টেরয়েড না দেওয়া।

> দীর্ঘদিন একটি ওষুধ ব্যবহারে এর কার্যকারিতা কমে গেলে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।