• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

শতবর্ষে ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১১ এপ্রিল ২০২২  

উস্তাদ আলী আকবর খাঁ সর্বকালের শেষ্ঠ সারোদবাদকদের মধ্যে অন্যতম। প্রতিটা রস, প্রতিটা মেজাজকে তিনি তার বাজনা দিয়ে ছুঁতে পারতেন। তার যে কোনও একটা বাজনা বার বার শুনেও যেন তার গভীরতার তল পাওয়া যায় না। তার বাজনা রাগ, লয়, তাল সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই এমন মানুষের চোখেও পানি এনে দিতে পারে।

ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পুত্র ও শিষ্য আলী আকবর খাঁ ভারতীয় যন্ত্রসংগীতে প্রথিতযশা শিল্পী। সরোদবাদনে তার নৈপুণ্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে।

কণ্ঠ সঙ্গীতের মাধ্যমে আলী আকবরের সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয় মাত্র তিন বছর বয়স থেকে। পিতা দশটির মত বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। কাজেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে তিনি তালিম নিতে শুরু করনে।

নয় বছর বয়সে তার বাবা তার হাতে তুলে দেন সরোদ। ১৯৩৩ সালে চাচা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ নিজ হাতে তৈরি একটি সরোদ তাকে উপহার দেন। পরবর্তীতে তিনি সরোদ যন্ত্রটি নিয়েই একনিষ্ঠভাবে সঙ্গীতচর্চা করে গেছেন। তিনি দৈনিক আঠারো ঘন্টা রেওয়াজ করতেন।

১৩ বছর বয়সে আলি আকবর খাঁ ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদে সর্ব প্রথম এক সঙ্গীত সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তিন বছর পরে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে সেই একই সম্মেলনে তিনি পণ্ডিত রবিশংকরকে সরোদে সঙ্গত করেন; এটাই তাদের প্রথম যুগলবন্দী ছিল। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র সাথে তিনি প্রথম কাজ করেন, এইবার তাকে তবলায় সঙ্গত করেছিলেন ঊস্তাদ আল্লা রাখা।

মুম্বাইতে চেতন আনন্দের 'আন্ধিয়াঁ' (১৯৫২) সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে সুরারোপ করার মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকেন। এই চলচ্চিত্রটির প্রধান গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। আলি আকবরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে গানটি গেয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী' (১৯৬০), তপন সিনহার 'ক্ষুধিত পাষাণ' (১৯৬০) এবং মার্চেন্ট আইভরির 'দ্য হাউসহোল্ডার'-এ কাজ করবার জন্য তিনি 'বছরের শ্রেষ্ঠ সংগীতকার' হিসেবে পুরষ্কৃত হন।

শংকর জয়কিষেণের সঙ্গীত পরিচালনায় 'সীমা' (১৯৫৫) শীর্ষক চলচ্চিত্রের একটি গানেও তিনি সরোদ বাজান। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে বার্নার্দো বার্তোলুচির পরিচালিত 'লিট্‌ল্‌ বুদ্ধা' শীর্ষক চলচ্চিত্রের জন্যও তিনি কিছু সুর রচনা করেন।

১৯৫৬ সালে হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখানো ও প্রচারের উদ্দেশ্যে কলকাতায় তিনি 'আলি আকবর কলেজ অব মিউজিক' প্রতিষ্ঠা করেন, ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে একই নামে তিনি আরেকটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে সান রাফায়েলে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৯ সালে বস্টনে পিবডি ম্যাসন কনসার্ট সিরিজে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন, তবলা সঙ্গতে ছিলেন পণ্ডিত শংকর ঘোষ। ১৯৮৫ সালে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের আরেকটি শাখা খোলেন সুইৎজারল্যান্ডের বাসেলে। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে লং প্লেয়ার অ্যালবামে রেকর্ড করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূরদর্শনে সরোদ পরিবেশন করেন।

১৯৭১ সালের কথা ভুলে থাকাটা আমাদের জন্য কঠিন। ১৯৭১ সালে মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশে’ রবি শংকর, আল্লারাখা ও কমলা চত্রক্রবর্তীর সঙ্গে ছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ। জর্জ হ্যারিসন ও রবিশংকরের আয়োজনে বাংলাদেশের জন্য অর্থ সংগ্রহের ওই আয়োজনে ছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটনসহ আরও অনেক বিখ্যাত শিল্পী। ১৯৭১-এর সঙ্গে তার এই সংযোগের সময় তিনি তার মাতৃভূমির স্বাধীনতার কথা ভবেছিলেন। যদিও তিনি তখন বৃহত্তর বিশ্বের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। নিজেকে তিনি ‘বাঙাল’ নামে অভিহিত করতেন।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের একজন অন্যতম পরিপূর্ণ সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ আলী আকবর খাঁ। সঙ্গীতে তার অসাধারণ সৃষ্টি তাকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সঙ্গীতে অমর করে রাখবে।