• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

আশ্রয়ণ: লাখো ঘরে আনন্দ অশ্রু

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২৬ এপ্রিল ২০২২  

চরম দুঃখ-দুর্দশা দিয়ে শুরু ভূমি ও গৃহহীন ফাতেমা বেগমের জীবন। অনাদর-অবহেলায় বড় হওয়া ফাতেমা মাত্র এক বছরে বয়সে বাবাকে ও সাত বছর বয়সে মাকে হারান। আপনজন বলতে ছিলেন একমাত্র ভাই। ফাতেমাকে একা রেখে তিনিও একদিন দুনিয়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান।

একমাত্র ভাই বেঁচে থাকতে জনম দুঃখী ফাতেমা বেগমকে বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিশোরী বয়সে ফাতেমার ঘরে একটি ছেলেও জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু সেই সুখও তার বেশিদিন সইলো না। ছেলের বয়স যখন এক বছর তখন তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে চলে যায়।

ফাতেমা চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শিলাইগড়া গ্রামের মেয়ে। বাবা-মা, ভাই, স্বামী হারা ফাতেমা গত ১৬ বছর একমাত্র সন্তানকে বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। অন্যের বাড়ি বাড়ি কাজ করে জীবন চলছে তার। নিজের ভিটে-মাটি না থাকায় কাজের বিনিময়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে বেঁচে আছেন তিনি। জীবন সংগ্রামে ফাতেমা উপোস থেকেছেন বহুদিন। ছেলেকে নিয়ে মরিচ-লবণ দিয়ে শুধু সাদা ভাত খেতে হয়েছে অসংখ্য বার।

ভূমি ও গৃহহীন ফাতেমা বেগমের কষ্টের দিন শেষ হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প থেকে দুই শতক জমি ও একটি পাকা ঘর পেয়েছেন তিনি। আরও শতাধিক মানুষের সঙ্গে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার হাজীগাঁও গ্রামে আশ্রয়ণের ঘর পেয়েছেন তিনি। ছেলেকে নিয়ে মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) নতুন ঘরে উঠবেন ফাতেমা। দুঃখ-কষ্টের দিন শেষে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তার চোখে এখন ঘর পাওয়ার আনন্দের অশ্রু। প্রাণ খুলে দোয়া করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

মঙ্গলবার ফাতেমা বেগমের মতো আরও ৩২ হাজার ৯০৪টি পরিবার ঘর পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে এসব ঘর হস্তান্তর করবেন।

সোমবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে ফাতেমা বেগমের সঙ্গে কথা হয় । অতীত জীবনের স্মৃতিচারণ আর ঘর পাওয়ার আনন্দের কথা বলতে গিয়ে ফাতেমা বার বার আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদেছেন।

ফাতেমা বেগম বলেন, আমার অনেক দুঃখ। আমার ছেলেকে নিয়ে মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করতাম, এখনো করি। চাল কিনতে পারতাম না। কম দামে চাল ভাঙা কিনতাম। বহুদিন উপোস থেকেছি, ছেলেকে শুধু মরিচ-লবণ দিয়ে সাদা ভাত খাইয়েছি। নিজে ভাতের পানি খেয়েছি।  

আশ্রয়ণ থেকে ঘর পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, এ রকম একটা ঘর পাবো জীবনেও কল্পনা করিনি। শুকরিয়া, প্রধানমন্ত্রী ঘর দিয়েছেন। আমার ছেলেকে নিয়ে মাথা গোঁজার ঘর পেয়েছি, আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।  

সরকারের পক্ষ থেকে সেলাই মেশিনসহ অন্যান্য সহযোগিতা পাওয়ার কথাও জানান ফাতেমা।  

আনোয়ারা উপজেলার হাজীগাঁওয়ে আশ্রয়ণের ঘর পাওয়া রহিমা বেগম, সুমি আক্তার, ফরিদা বেগম, এআর মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজ। ঘরে পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ তারা। ঘর পাওয়ার আনন্দের কথা বলতে আবেগাপ্লুত হয়েছেন, কেঁদেছেন তারা।

ভূমি-গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় মানুষকে ঘর ও জমি দেওয়া হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে। গত দেড়-দুই বছরে চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা, খুলনা, সাতক্ষীরা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, রংপুর, কুড়িগ্রাম, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, আশ্রয়ণের ঘর পেয়ে বহু মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনা।

ঘর পাওয়ার আনন্দ অশ্রু শুধু ফাতেমা বেগমের চোখে নয়, সারা দেশের লাখ লাখ পরিবারের সদস্যদের চোখে আজ এ আনন্দ অশ্রু।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানান, তৃতীয় ধাপে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ফাতেমা বেগমের মতো মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঈদ উপহার হিসেবে ঘর পাচ্ছে আরও ৩২ হাজার ৯০৪টি পরিবার। তৃতীয় ধাপে আরও ৩২ হাজার ৭৭০টি ঘর নির্মাণাধীন রয়েছে। এর আগে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ঘর পেয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি পরিবার।

আশ্রয়ণের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের চেয়ে তৃতীয় ধাপের ঘরগুলো অনেক বেশি টেকসই জানিয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, এবারে তৃতীয় পর্যায়ে যে কাজটি করছি এরমধ্যে বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে এ ঘরটিকে অধিকতর টেকসই করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় ধাপে একেকটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা। তৃতীয় ধাপের ঘরগুলোতে আরসিসি পিলার, গ্রেড ভিম, টানা লিংকটারসহ বেশ কিছু বিষয় সংযোজন করার কথা জানান প্রকল্প পরিচালক।  

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন কবলিত ভূমি-গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২২ সালে মার্চ পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজার ২৪৪ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সুবিধাভোগীদের মধ্যে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, হিজড়া, বেদে সম্প্রদায়সহ সমাজের পিছিয়ে পড়া ভাসমান বিভিন্ন জনগোষ্ঠীও রয়েছে।

পৃথিবীর কোথাও এভাবে ঘর ও জমি দেওয়া হয় না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব বলেন, দুই শতক জমি দেওয়া হচ্ছে, রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ দলিল করে দেওয়া হচ্ছে, মিউটেশন করে দেওয়া হচ্ছে। জমির মালিক উনি, তারপরে ওই ঘরের মালিক উনি। একটা মানুষের মধ্যে ওনারশিপ আসে, মালিকানার একটা বোধ আসে। সে এটাকে রক্ষাণাবেক্ষণ করবে, লালনপালন করবে। এখান থেকে পুরো একটা ইনক্লুসিভ উন্নয়ন হবে। এজন্য আমরা এটাকে বলি অন্তর্ভুক্তিমূলক শেখ হাসিনা মডেল। পৃথিবীতে কোথাও এ মডেলটা কিন্তু নেই।