• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

বাবাকে ফোনে আত্মসমর্পণ করবে বলেছিল ‘নিখোঁজ রাইয়ান’

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২৮ মে ২০২৩  

কিশোর আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানের (১৬) বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। আল-আমিন নামে একজন ছিলেন তার গৃহশিক্ষক। ২০২২ সালের মার্চে গৃহশিক্ষকের কথায় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি ছাড়ে রাইয়ান। নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়’য় উদ্বুদ্ধ করে তাকে প্রশিক্ষণের জন্য তথাকথিত হিজরত করান আল-আমিন। গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তার নির্দেশনায় পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য রনি মিয়া নামে একজন রাইয়ানকে বান্দরবানে দিয়ে যান। এরপর আর বাড়ি ফেরেনি রাইয়ান।

শুধু রাইয়ান নয়, দুই বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে বাড়ি ছাড়ে ৫৫ কিশোর-যুবক। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন র‌্যাব ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের হাতে গ্রেফতার হয়। তবে এখনো নিখোঁজ অনেকে।

নিখোঁজ তরুণ আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান এক বছরের বেশি সময় ধরে আত্মগোপনে থাকলেও সম্প্রতি বাড়িতে ফোন করে। ফোনে মাত্র ৪১ সেকেন্ড কথা হয় তার বাবার সঙ্গে। এসময় রাইয়ান আত্মসমর্পণের কথা জানায়। কিন্তু যে নম্বর থেকে ফোন করেছিল সেটি এখন বন্ধ।

ছেলের শোকে পাগলপ্রায় রাইয়ানের মা-বাবা এখনো পথ চেয়ে রয়েছেন ছেলে ফিরে আসবে। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলেই বুক কেঁপে ওঠে রাইয়ানের মা-বাবার। মনে করেন তার ছেলে ফোন করেছে। এভাবে টানা এক বছর ধরে অপেক্ষা করেও ছেলের খোঁজ পাননি তানজীব-এমিলি দম্পতি।

গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, ‘জঙ্গিবাদে’ জড়িয়ে দুই বছর ধরে বাড়ি ছাড়া ৫৫ জনের খোঁজ পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গত বছরের ১০ অক্টোবর তাদের মধ্যে ৩৮ জনের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। নিখোঁজ তরুণদের মধ্যে নাম উঠে আসে নারায়ণগঞ্জের আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান নামে এক কিশোরের। রাইয়ান জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিল গৃহশিক্ষক আল-আমিনের মাধ্যমে। শুধু রাইয়ান নয়, গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন তার মা আম্বিয়া সুলতানা এমিলিও।

এমিলি দেশের একটি স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সে কেবিন ক্রু হিসেবে চাকরি করতেন। সুন্দর ও নিরাপদ জীবন ফেলে বিপথে চলে যাওয়ায় অনুতপ্ত হন এমিলি। পরে গত বছরের ৯ নভেম্বর পাহাড়ে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া ছেলেকে ফিরে পেতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আকুতি জানান।

র‌্যাব বলছে, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি উগ্রবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ছত্রছায়ায় নিখোঁজদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখানে তারা নতুন ওই জঙ্গি সংগঠনের নামেই অবস্থান করে। নিখোঁজদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিভিন্ন সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তরুণদের।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন তরুণ নিখোঁজ। তাদের সঙ্গে নিখোঁজ জঙ্গি সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের কয়েকজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ধারাবাহিক অভিযানের ফলে পাহাড়ে প্রশিক্ষণরত যেসব তরুণ ছিল তারা আমিরের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মগোপনে রয়েছে।

গত বছরের ৯ নভেম্বর নিখোঁজ আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানের মা আম্বিয়া সুলতানা এমিলি সাংবাদিকদের বলেন, দেশের একটি স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সে কেবিন ক্রু হিসেবে চাকরি করতাম। আমার ছেলের গৃহশিক্ষক ছিলেন আল-আমিন। সেই শিক্ষকের মাধ্যমেই আমি ও ছেলে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ি। এরপর র‌্যাব আমাকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। সুন্দর ও নিরাপদ জীবন ফেলে বিপথে চলে যাওয়ায় আমি অনুতপ্ত।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলেকে উদ্ধারের জন্য সহায়তা চাই। আমার ছেলের মতো যেন আর কোনো সন্তান এভাবে জঙ্গিবাদে না জড়ায়।

র‌্যাব জানায়, আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান নিখোঁজের ঘটনায় তার বাবা তানজীব মাহমুদ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু তখনো রাইয়ানের বাবা স্ত্রী-সন্তানের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জানতেন না। পরে র‌্যাব নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করলে রাইয়ানের নাম প্রকাশ্যে আসে।

সবশেষ রাইয়ানের অবস্থান জানতে যোগাযোগ করা হয় তার বাবা তানজীব মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাইয়ানের মায়ের ব্রিফিং দেখে সে একবার ফোন করেছিল বাসায়। ফোনে রাইয়ান বলেছিল- বাসায় ফিরে আসবে এবং আত্মসমর্পণ করবে। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি র‌্যাবকে জানানো হয় এবং নম্বরটিও তাদের দেওয়া হয়। ফোনটি এসেছিল ঈদের আগে। এরপর আর কোনো ফোন করেনি রাইয়ান। একটি রবি নম্বর থেকে ফোন এসেছিল, সেটিও বন্ধ।

বাবাকে ফোনে আত্মসমর্পণের কথা বলে ‘নিখোঁজ রাইয়ান’

তিনি বলেন, ব্যবসার কাজে আমি খুব ভোরে উঠি। দুপুরে বাসায় এসে মোবাইল সাইলেন্ট করে একটু ঘুমাই। মোবাইলে কোনো ফোন এলে রিসিভ না করতে পারলে পরে আমি কলব্যাক করি। মনে হয় আমার ছেলেই হয়তো ফোন দিয়েছে। ছেলে নিখোঁজের পর থেকেই র‌্যাবের কর্মকর্তারা অনেক সহযোগিতা করেছেন। তারা নিয়মিত ফোন করে খোঁজ-খবর নেন।

রাইয়ানের বাবা আরও বলেন, ছেলের শোকে ওর মা সব সময় কান্নাকাটি করে। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাকভাবে করে না। আশা ছিল ছেলেটা আত্মসমর্পণ করবে, কিন্তু এখনো তার কোনো খোঁজ নেই। ছেলের এ অবস্থায় সংসারও ভালোভাবে যাচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে ও আর আমি কী অবস্থায় আছি তা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। ছেলেকে অনুরোধ করে বলবো- ভুলতো মানুষই করে। ওর বয়স কম। ও যেন দ্রুত ফিরে এসে আত্মসমর্পণ করে।

এ বিষয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত বছরের ৯ নভেম্বর স্বেচ্ছায় ঘরছাড়া ১৯ জেলার নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। সেই তালিকার অনেকেই এরই মধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন এখনো পলাতক। অর্থাৎ, আইনের আওতায় আনা যায়নি। ৫৫ তরুণ ছাড়াও অন্য যারা স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান চলমান।

জঙ্গিবাদে জড়ানো গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দা সূত্রে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ধারাবাহিক অভিযানের ফলে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আমিরের নির্দেশে পাহাড় ছেড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মগোপনে রয়েছে।

নিখোঁজ রাইয়ানের বিষয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, গৃহশিক্ষকের পরামর্শে জঙ্গিবাদে জড়ানো রাইয়ানকে খুঁজতে পাহাড়সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চলমান। শুধু রাইয়ান নয়, নিখোঁজ সব তরুণকে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে আইনের আওতায় আনা হবে।