• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গর্ভে সন্তান নিয়ে আরেক প্রসূতির নবজাতক চুরি

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩  

তানিয়া আক্তার দুই সন্তানের জননী। বড়জন ছেলে, পরে মেয়ে। আবারও ছেলেসন্তানের আশা পরিবারের। ‘কটু’ কথা শোনার ভয়ে প্রসূতিও আশায় ছিলেন ছেলেসন্তানের। প্রবাসে থাকা স্বামীকেও জানিয়ে দেওয়া হয় ছেলেসন্তান হচ্ছে।  

কিন্তু আধুনিক চিকিৎসার বদৌলতে তানিয়া জানতে পারেন গর্ভে মেয়েসন্তান। এর পরই তিনি নানা ফন্দি আঁটতে থাকেন। নিজের সন্তান হওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি চুরি করেন আরেকজনের নবজাতক ছেলে। অতঃপর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। রাতেই তিনি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। চুরির পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে রেখা বেগমের নবজাতককে  উদ্ধার করেছে পুলিশ। এতে পুলিশের দায়িত্বশীলতা প্রশংসা পাচ্ছে। অন্যদিকে কন্যাসন্তান হওয়ার শঙ্কা থেকে নারীর এহেন চুরির ঘটনা সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল থেকে রেখা বেগমের তিন দিনের শিশু চুরি হয়। বিকেল ৫টার দিকে ওই শিশুটিকে উদ্ধার করে সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় দিকে মায়ের কোলে তুলে দেয় পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত তানিয়া বেগম নামে এক নারীকে আটক করা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজ, মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে ওই নারীর কাছ থেকে শিশুটিকে পুলিশ উদ্ধার করে। আটক তানিয়া ওই দিনই দিবাগত গভীর রাতে জেলা সদর হাসপাতালে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।

ওই দুই নারীসহ তাদের সন্তানরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ঢুকতেই রেখা বেগম ও কয়েকটি বেড পেরিয়ে তানিয়া আক্তার অবস্থান করছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের উদ্যোগেই দুজনকে একটু দূরে সরিয়ে রাখেন। তানিয়া যেখানটায় আছেন, এর ঠিক পাশেই ছিল রেখার শয্যা। তানিয়া রয়েছেন পুলিশের তত্ত্বাবধানে। তার বিরুদ্ধে রেখার স্বামী মামলা দায়ের করেছেন। এ ঘটনায় দায়িত্বরতরাও মর্মাহত।   

রেখার নবজাতক উদ্ধারের পরই দৃশ্যপটের বদল। ভিড় ঠেলে ঢুকতে হয় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে। সন্তান কোলে মা রেখার চোখে আনন্দাশ্রু। স্বজনরা দুই হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। মুখে হাসি নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। উদ্ধার অভিযানের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল থেকে নবজাতক চুরির পর পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্বশীলতার বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। একজন মায়ের কোলে ঔরসজাত সন্তান ফিরিয়ে দিতে পেরে পুলিশও নিজেদেরকে ধন্য মনে করছে।

ঘটনা সম্পর্কে একাধিক সূত্রে জানা যায়, জেলার সদর উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের তেলিনগর গ্রামের কৃষক ফরিদ মিয়ার স্ত্রী ও মজলিশপুর ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামের বাবুল মিয়ার মেয়ে সোমবার প্রসবব্যথা নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে তিনি সেখানে একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে এক নারী কৌশলে ওই শিশুটিকে নিয়ে চম্পট দেয়।

রেখার দাদি জুবেদা খাতুন বলেন, আমি শিশুটিকে নিয়ে বসেছিলাম। এমন সময় বোরকা পরা মাঝবয়সী এক নারী নিজেকে গর্ভবতী বলে দাবি করেন। এ সময় ওই নারী বলতে থাকেন, এখানেই তার প্রসব হবে। যে কারণে হাসপাতালটি দেখতে এসেছেন। তার স্বামী বড়লোক। অনেককে টাকা দেন। তিনিও দান করতে পছন্দ করেন। এসব বলতে বলতে আমার হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেন, নবজাতকের মায়ের জন্য যেন ফল নিয়ে আসেন। অনেক আপত্তির পরও ওই নারী জোর করে টাকাটা দেন। টাকা নিয়ে আমি ফল আনতে বাইরে যাই। ১০ বছর বয়সী আমার আরেক নাতি তৃষার কোলে শিশুটিকে দিয়ে যাওয়া হয়।

রেখা বেগম জানান, বোরকা পরা ওই নারী বলতে থাকেন নবজাতকের ঠাণ্ডা লেগেছে। তাই তিনি চিকিৎসা করাতে চান। রেখাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভালো চিকিৎসকের কাছে যেতে চান। রেখা এতে অপারগতা প্রকাশ করলে শিশু তৃষাকে নিয়ে ওই নারী বের হয়ে যান। প্রায় এক ঘণ্টা পর তৃষা এসে জানায়,  শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া নারীকে সে খুঁজে পাচ্ছে না। পরে জানা যায়,  নবজাতককে সন্ধানী নামে একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সটকে পড়েন ওই নারী।

সন্ধানী সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ এস এম আব্দুর রহিমের সহযোগী আতিকুর রহমান শিমুল বলেন, দুপুরের দিকে এক নারী নবজাতক নিয়ে এসে ডাক্তার দেখাবেন বলে ৫০০ টাকা ভিজিট দিয়ে সিরিয়াল নেন। একপর্যায়ে সঙ্গে থাকা ১০-১২ বছরের শিশুটিকে তিনি টয়লেটে যেতে বলেন। এরই মধ্যে ওই নারী নবজাতটিকে নিয়ে পালিয়ে যান। অনেকক্ষণ পর শিশুটির মাধ্যমে জানতে পারি, সদর হাসপাতাল থেকে নবজাতকটিকে নিয়ে আসা হয়। আমি তখন শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই।

একই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুর রহমান বলেন, হাসপাতালে আসার পর আমি ঘটনা জানতে পারি। ওই নারী নবজাতককে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাননি। কৌশলে ওই নারী নবজাতকে নিয়ে পালিয়ে গেছেন।

এদিকে বোরকা পরা ওই নারী আর ফিরে না আসায় নবজাতকের স্বজনদের সন্দেহ হয়। বিষয়টি তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে অবহিত করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ছুটে এসে ঘটনা জেনে তৎপরতা শুরু করে। শুরুতেই তারা একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ দেখে। এর মাধ্যমে ওই নারী সম্পর্কে ধারণা নেয় পুলিশ। পরে একটি মোবাইল ফোন নম্বরের সূত্র ধরে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে সদর উপজেলার নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নের সিন্দুউড়া গ্রাম থেকে তানিয়া আক্তার নামে ওই নারীসহ নবজাতককে উদ্ধার করে পুলিশ। সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিশুটিকে হাসপাতালে এনে মায়ের কোলে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ এমরানুল ইসলাম, পরিদর্শক (তদন্ত) সোহরাব আল হোসাইনসহ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের ইনচার্জ সেবিকা ববিতা রানী দাস বলেন, নবজাতককে ওই নারী নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা কাজে ছিলাম। নবজাতকের স্বজনদের কাছে চুরির বিষয়টি জানতে পারি। পরে পুলিশ এসে বিস্তারিত জেনে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে।

সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মাদ এমরানুল ইসলাম বলেন, নবজাতককে অক্ষত অবস্থায় মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরে আমাদের খুব ভালো লাগছে। আমরা বেশ খুশি। এটা আমার চাকরিজীবনের সেরা উদ্ধার তৎপরতা।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ওই নারী স্বর্ণের অলংকার বিক্রি করে নবজাতককে সহায়তা করে। আমরা যতটুকু বুঝতে পেরেছি ওই নারী নানা কারণেই চাচ্ছিলেন তার ছেলেসন্তান হোক। প্রবাসী স্বামীকেও ছেলেসন্তান হওয়ার খবর তিনি জানিয়েছেন। এসব কারণেই তিনি ছেলেসন্তানটি চুরি করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ওই নারী একেক সময় একেক কথা বলছেন। কাজেই এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে রেখা বেগমের স্বামী মামলা করেছেন। আমাদের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে।
   
রেখা বেগম সন্তানকে কোলে পেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কান্না করছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করছিলাম। সবার দোয়ায় আমি আমার সন্তানকে খুঁজে পেয়েছি। এ জন্য আমি পুলিশসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। রেখা জানান, এরফান নামে তার আরেক ছেলেসন্তান রয়েছে।

তানিয়া আক্তার বলেন, বাচ্চাটাকে চুরি করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। আমি বলে-কয়েই ওই বাচ্চাটা নিয়ে গিয়েছিলাম লালন-পালন করার জন্য। কিন্তু কী কারণে এমন করেছি আমি জানি না।

তানিয়ার মা স্বপ্না বেগম বলেন, চুরির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার মেয়ে হুট করে আমাকে জানায় যে তার ছেলে হয়েছে। কিন্তু কেন সে এমন করল আমি জানি না। মেয়েসন্তান হওয়া নিয়ে কারো কোনো আপত্তির কথাও আমি জানি না। প্রবাসে থাকা তার স্বামীও এ নিয়ে কিছু বলেনি।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের অবেদনবিদ সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ওই নারী কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। এ সময় তার এক স্বজন বলছিলেন, ওই নারী নাকি ছেলেসন্তান জন্ম দেবেন বলছিলেন।। কেন কন্যা হলো এ নিয়ে হুল্লোড় করছিলেন তিনি।’