• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

পথে পণ্য চুরি, রপ্তানিতে বাজার হারাচ্ছিল পোশাক খাত

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১  

বিদেশে রপ্তানির জন্য কোনো কারখানার তৈরি পোশাক যখন ট্রাক-কাভার্ডভ্যানে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে যেতো, তখন রাস্তায় একটি অসাধু পরিবহন ও চোর চক্র সুকৌশলে প্রতিটি চালান থেকে কিছু মাল সরিয়ে ফেলতো। চক্রটি দীর্ঘদিন এভাবেই চৌর্যকর্মে সম্পৃক্ত ছিল। এতে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি প্রশ্নের মুখে পড়ছিল সম্ভাবনাময় এ খাত। নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে গণনায় পণ্য কম পাওয়ায় বিদেশি বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল বাংলাদেশি পোশাক পণ্য আমদানি থেকে। এ নিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের ক্ষোভও ছিল দীর্ঘদিনের।

রপ্তানির পোশাক চোর সিন্ডিকেটের এমনই সাত সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। চক্রটি প্রথমে ঢাকার আশেপাশে পণ্য চুরি করলেও ডিবির ধারাবাহিক অভিযানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। সম্প্রতি একটি পোশাক কারখানা থেকে ২৮ হাজার ৮২০ পিস তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সেই চালান বিদেশে পৌঁছানোর পর ১১ হাজার পিস পোশাক কম পান বায়াররা। এ কারণে বিদেশি বায়ার বাংলাদেশি ওই কারখানা মালিককে ২৮ হাজার ৯০৮ ডলার ক্ষতিপূরণ বাবদ জরিমানা করে।

চক্রের এক কাভার্ডভ্যান চালকের ফোন নম্বর পর্যালোচনার পর চোর চক্রকে শনাক্ত করা হয়। পরে রাজধানীর উত্তরা ও কুমিল্লার বুড়িচং থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে ডিবির তেজগাঁও ডিভিশন। এসময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি পোশাক জব্দ করা হয়।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে এ চোর চক্রটি নানা কৌশলে রপ্তানির পোশাক চুরি করে আসছিল। তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য ঢাকা থেকে কাভার্ডভ্যানে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে চক্রটি পণ্য চুরি করতো। এতে বিদেশি ক্রেতারা হিসাবের চেয়ে কম পণ্য পেতো এবং এ নিয়ে তারা বছরের পর বছর ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন।

সম্প্রতি এ ধরনের একাধিক ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে ক্রেতাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুকারক ও রপ্তানিকারক সমিতিকে (বিজিএমইএ) চিঠি দিয়েছেন অনেক বিদেশি বায়ার।

গ্রেফতাররা হলেন- চক্রের মূলহোতা মো. সাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে সিলেটী সাঈদ, রাজ্জাক, ইউসুফ, মাইনুল, আল আমিন, দুলাল হোসেন ও খায়রুল। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪ হাজার ৭০৫ পিস তৈরি পোশাকসহ দুটি কাভার্ডভ্যান জব্দ করা হয়।

সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, মালামাল পরিবহনে যুক্ত শ্রমিকদের এ চক্রের মূল হোতা সাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে সিলেটী সাঈদ। সাঈদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ২৪টি মামলা রয়েছে। এর আগে সে চট্টগ্রামে চুরির অপরাধে জেলও খেটেছে। মূলত, তার নেতৃতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দল ও উপদল রয়েছে। কোনো গার্মেন্টস থেকে শিপমেন্টের উদ্দেশ্যে ট্রাক/কাভার্ডভ্যান লোড হওয়ার পর চালক ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন স্থানে, যেমন- উত্তরা, ডেমরা, সানারপাড়, রূপগঞ্জ, কুমিল্লার বিভিন্ন স্থান, ফেনী, মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন ডিপো বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা বা গ্যারেজে গাড়ি ঢুকিয়ে খুব অল্প সময়ে কাভার্ডভ্যানের সিল অক্ষত রেখে প্রতি কার্টুন থেকে ২০-৪০ পিস সরিয়ে আবার আগের মতো কার্টুনগুলো স্কস্টেপ লাগিয়ে কাভার্ডভ্যান পোর্টে নিয়ে যেতো।

তিনি আরও বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও জোনাল টিম তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকা মহানগরীর উত্তরা এলাকা থেকে চোরাই গার্মেন্টস মালামাল ও একটি কাভার্ড ভ্যানসহ রাজ্জাক, ইউসুফ, খায়রুল ও মাইনুলকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্যমতে, কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানা এলাকা থেকে চোরাই গার্মেন্টস মালামাল ও একটি কাভার্ডভ্যানসহ আল-আমিন ও দুলালকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে এবং তাদের দেওয়া তথ্যমতে চক্রের মূলহোতা সাহেদকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ২৪টি মামলা রয়েছে। সাহেদ চট্টগ্রামে ৬টি মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছিলো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ জানায়, তারা পাঁচ হাজারের বেশি ট্রাক/কাভার্ডভ্যান থেকে বিভিন্ন সময় কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য চুরি করেছে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর পৃথক অভিযানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার অপর একটি মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত গার্মেন্টস মালামাল চোরাই চক্রের মূলহোতা মহিউদ্দিন, মোবারক, ইব্রাহিম ও কাভার্ডভ্যান চালক এমরানকে গ্রেফতার করা হয়। এরইমধ্যে গ্রেফতার এমরান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

ডিবি প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার আরও বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ট্রাক/কাভার্ডভ্যান এজেন্সি/চালক/শ্রমিকের সহায়তায় পোশাক পণ্য চুরি করে আসছিল। এর ফলে সম্ভাবনাময় রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প দিন দিন ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ছিল। এতে গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছিল ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশীয় এ খাতের সুনাম নষ্ট হচ্ছিল।

পোশাক পণ্য চুরি ঠেকাতে গোয়েন্দা পুলিশের সুপারিশ-
১) পণ্য পরিবহনের সময় গার্মেন্টসের নিজস্ব পরিবহন ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান ব্যবহার করা।
২) এজেন্সির ট্রাক/কাভার্ডভ্যান ভাড়া করা হলে চালকের পরিচয়পত্র/ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি রাখা এবং
চালকের ছবি তুলে পোর্টে সিএন্ডএফ এজেন্টকে Whatsapp-এ পাঠিয়ে দেওয়া। একই চালক কি না,
সেটা সিএন্ডএফ এজেন্ট যাচাই করবে।
৩) সম্ভব হলে এস্কট করে পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যান পোর্টে পৌঁছানো।
৪) ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান কোথাও থামল কি না, তা দেখার জন্য ট্রাক/কাভার্ডভ্যানে জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার ও মনিটরিং করা।
৫) বৈধ ও প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সপোর্টের গাড়ি ব্যবহার করা।
৬) পোর্টে পৌঁছানোর পর সিএন্ডএফ এজেন্ট যাতে লাগাতার কয়েকটা কার্টুন চেক করে এবং স্কেলে ওজন
পরিমাপ করে, তার ব্যবস্থা করা এবং
৭) এ রকম ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করা।