• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন
ব্রেকিং:
২০৩২ সাল পর্যন্ত ইইউতে জিএসপি সুবিধা পেতে আয়ারল্যান্ডের সমর্থন চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে পাশে আছি: প্রধানমন্ত্রী জনসমর্থন থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা অসম্ভব রোহিঙ্গাদের জন্য বৃহত্তর তহবিল সংগ্রহে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান লেখাপড়ার নামে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি না করার আহ্বান বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বিশ্বে অনেক বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে: প্রধানমন্ত্রী ট্রাস্ট করে ভাষা সংরক্ষণ-উন্নয়নের উদ্যোগ, হচ্ছে আইন ‘কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার’ ইফতার পার্টি না করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ প্রধানমন্ত্রীর

যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারি ২০২৩  

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অবিসংবাদিত নেতা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি তিনি। বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস মানেই বাংলাদেশের ইতিহাস। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও দেশে ফেরার আগে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে বন্দি করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। আটকে রাখা হয় কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে। তবে বন্দি হওয়ার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেয়া এ ঘোষণায় সর্বস্তরের জনগণকে দেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হলেও মূলত তার নেতৃত্বেই মুক্তির সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ।

প্রায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। পরাজিত পাকিস্তানি শাসকরা অবশেষে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তার মুক্তির মধ্য দিয়ে আসে বিজয়ের পূর্ণতা। পাকিস্তানের কারাগারে ২৯০ দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের ভূমিকা

বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের ভূমিকা অপরিসীম, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গবন্ধু যেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং সসম্মানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে ব্যক্তিগতভাবেও নজিরবিহীন ভূমিকা রাখেন ইন্দিরা গান্ধী।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিকে ‘বাংলাদেশ সংকট’ সমাধানের অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে উল্লেখ করে পুরো বিশ্বে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধুকে যখন প্রহসনমূলক গোপন ‘বিচারে’ হত্যা করার ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত করা হয়, তখন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ২৪ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে চিঠি লেখেন ইন্দিরা গান্ধী। যার জবাবে পাকিস্তানকে শক্ত ভাষায় সতর্ক করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশ প্রশ্নে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা এবং ওয়াশিংটনের দুর্ভাগ্যজনক পাকিস্তানপন্থি কৌশলগুলো কার্যত অকার্যকর করে দেন ইন্দিরা গান্ধী। তার যুক্তি, দৃঢ়তা এবং বিস্ময়কর আন্তর্জাতিক জনসংযোগের ফলে বিশ্ব জনমত আসে বাংলাদেশের পক্ষে।

এদিকে মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে একাত্তরের অক্টোবর-নভেম্বর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত হতে থাকে। এর মধ্যেই ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিম অংশে পাকিস্তান আকস্মিক আক্রমণ চালালে যুদ্ধ পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড’। একইদিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালিতে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক বসে।

সে বৈঠকে ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর করার প্রস্তাব আনা হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার ‘ভেটো’ দিয়ে প্রস্তাবটিকে অকার্যকর করে দেয়। ফলে যৌথ বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ পাকিস্তান বাহিনী দ্রুত পরাজয়বরণ করতে থাকে এবং আত্মসমর্পণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।

ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধু সাক্ষাৎ

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিনটি ছিল সোমবার। ব্রিটিশ সরকারের একটি বিশেষ বিমানে করে সেদিন সকাল ৮টা নাগাদ দিল্লির বিমানবন্দরে অবতরণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এর ঠিক দুদিন আগেই (৮ জানুয়ারি) পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি এবং সেদিনই পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) একটি বিশেষ ফ্লাইটে তিনি লন্ডনে যান।

লন্ডনে প্রায় ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করেন বঙ্গবন্ধু। এই সময়ে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে ঢাকার পথে যাত্রা করেন তিনি। ১০ জানুয়ারি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) যাত্রাবিরতি করেন বঙ্গবন্ধু।

দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমে ভারতের জনগণের উদ্দেশে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘আমি বাংলাদেশে যাওয়ার পথে আপনাদের মহান দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে বিরতি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ আমি আমার জনগণের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকারকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি।’

বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য ও শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে ঐতিহাসিক অভ্যর্থনা জানান। এরপর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে শেখ মুজিবকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, একুশবার গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হয়। ওড়ানো হয় বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা। বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সংগীত।

বঙ্গবন্ধুকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিশ্বের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা। আপনি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন।’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু ভারতের জনগণ ও সরকার, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান।

সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তরুণ কর্মকর্তা ছিলেন দেব মুখার্জি। পরবর্তীতে যিনি ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে দেব মুখ্যার্জি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতকে অভিনন্দন জানিয়ে শেখ মুজিব উষ্ণ ভাষণ দেন। ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিব একই মঞ্চে বক্তৃতা করেন সেদিন।

সে ভাষণে শেখ মুজিব বলেন, ‘আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্য বাহিনী, আপনাদের জনগণ যে সাহায্য এবং সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছে, বাংলার মানুষ তা কখনও ভুলতে পারবে না।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের জন্য ইন্দিরা গান্ধী কূটনৈতিকভাবে যে ভূমিকা রেখেছিলেন সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শেখ মুজিব।

ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দুদিন আগেও আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলে বন্দি ছিলাম। শ্রীমতি গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন কোনো জায়গা নাই যেখানে তিনি চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ।’

ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথমবারের সাক্ষাতেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি চূড়ান্ত করেন বঙ্গবন্ধু। মূলত লন্ডন থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনকালে বিমানের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন তিনি, যা তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দূরদর্শিতাই প্রমাণ করে।

লন্ডন থেকে যে ব্রিটিশ বিমানে করে বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন, ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে ওই বিমানে ছিলেন দেশটির কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। বিমানেই বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, ‘দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তার কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।’
এরপর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি জানতে চান, পাকিস্তানি হানাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বুক মিলিয়ে একত্রে যুদ্ধ করা ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশ ত্যাগ করবে কবে? বঙ্গবন্ধুর অদম্য নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই সেদিন ভারতীয় সেনাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ইন্দিরা গান্ধী।
এরপর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুই দিনের সফরে (৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২) ভারতে যান বাংলাদেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। কলকাতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি আবারও ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের প্রসঙ্গ তোলেন এবং তাদের প্রত্যাহারের নির্দিষ্ট তারিখ জানতে চান।

বঙ্গবন্ধুর মতো একজন আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী নেতার কথার গুরুত্ব অনুধাবন করতে আর সময় নেননি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। কিছুক্ষণ ভেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘ইয়োর এক্সেলেন্সি, ১৭ মার্চের আগেই সবশেষ ভারতীয় সেনাটিও বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসবে।’

কথা মতো, ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে শুরু করে। ওইদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্ণাঢ্য বিদায়ী কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তায় স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশ ত্যাগ করে। লন্ডন থেকে সরাসরি ঢাকায় না এসে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে দিল্লিতে যাত্রাবিরতি ও ইন্ধিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ যে বঙ্গবন্ধুর অন্য সব সিদ্ধান্তের মতোই ঐতিহাসিক, তা একবাক্যেই স্বীকার করেন সবাই।