• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মাদারীপুর দর্পন

বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন (১৯৪৯)

মাদারীপুর দর্পন

প্রকাশিত: ২৩ জুন ২০২২  

সমকালীন রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখেই কোনো একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। এ উপমহাদেশ ব্রিটিশ রাজের শাসনকাল ছিল প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি। ব্রিটিশদের শাসন-শোষণের জাঁতাকলে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের নাগরিক হয়ে ওঠার কোনো সুযোগ ছিল না। শুধু সাধারণ জনগণ হিসেবেই পরিচিত ছিল। নাগরিক হয়ে উঠতে হলে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্রিটিশ শাসন আমলে কতিপয় রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অন্যতম। এই কংগ্রেসের নেতৃত্বেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সময়ের বিবর্তনে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে, তাদের এ অঞ্চলে থাকার সুযোগ নেই। তারপরও নানা কূটচালে ব্রিটিশ শাসক এখানকার মানুষের মধ্যে একটা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি প্রতিষ্ঠিত করে যাওয়ার অপপ্রয়াস চালায়। ইংরেজরা এখান থেকে চলে গেলেও যেন সাম্প্রদায়িক চেতনা বলবৎ থাকে। ১৯৪৭ সালে রক্তপাতহীন স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির আলোকে দুটি দেশের জন্ম ঘটে। একটি ভারত, অন্যটি পাকিস্তান। পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতি প্রথম দিকে পাকিস্তানের জন্মকে স্বাগত জানায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়, অন্যদিকে ১৫ আগস্ট নিখিল ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের দিন ধার্য হয়। পাকিস্তানি শাসন-শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট জনগণ অতীষ্ঠ হয়ে পরে। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি হলেও শাসন ক্ষমতা অর্পিত হয় অবাঙালিদের হাতে। শুরু থেকে বাঙালি জাতি বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। আমরা বাঙালিরা নানাভাবে শোষিত হতে থাকি। এই শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলীম লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলির কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে এক সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসন আমলেও প্রাদেশিক মুসলিম লীগেরই একাংশ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদন নির্বাচিত হন শামসুল হক। এখানে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে আওয়ামী লীগের জন্মের পেছনে ১৫০ নম্বর মোগলটুলির পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরে উদ্যোগের বিষয়টি। ২৩ জুনের সম্মেলন আয়োজনে কর্মী শিবিরের নেতা শকওত আলীর ভূমিকা ছিল। শওকত আলীর ১৫০ নম্বর মোগলটুলির বাসভবনই ছিল কর্মী শিবিরের কার্যালয়। ২৩ জুনের সম্মেলন প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম এখান থেকেই শুরু হয়। শওকত আলীর অনুরোধে কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকায় আসেন। সোহরাওয়ার্দী শওকত আলীকে পরামর্শ দেন মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার। শওকত আলীর এ পরামর্শে অণুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। কর্মী শিবিরের প্রধান নেতা ছিলেন শামসুল হক। কামরুদ্দিন আহমদ, মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আব্দুল আউয়াল, মুহাম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা এর প্রথম দিকে এবং পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান কর্মী শিবিরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় বিশেষভাবে যুক্ত হন। মুসলিম লীগের আবুল হাসিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যেই কর্মী শিবির গড়ে তুলেছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আসামের ধুবড়ী জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় এসে আলী আমজাদ খানের বাসায় অবস্থান করছিলেন, এ সময় শওকত আলী ভাসানীর সঙ্গে দেখা করে কর্মী শিবিরের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে আলোচনা করেন। নতুন দল গঠনের লক্ষ্যে শওকত আলীর ১৫০ নম্বর মোগলটুলির বাসায় একটি বৈঠক হয়, সে বৈঠকে মওলানা ভাসানী উপস্থিত ছিলেন। ২৩ ও ২৪ জুনের সম্মেলনকে সামনে রেখে একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন ইয়ার মুহম্মদ খান এবং দপ্তর সম্পাদক হন খোন্দকার মুশতাক আহমদ (যিনি বিশ্বাসঘাতক খুনি মুশতাক হিসেবে পরবর্তী সময়ে পরিচিত) গঠিত এই কমিটি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে যে সম্মেলন আহ্বান করেন, সেই সম্মেলনেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়, যা আগে উল্লেখ করেছি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবুর রহমান হন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। শুরু হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের পথচলা। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৫৩ সালে ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত একটানা ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। প্রথম দিকে প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের অবসান। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পর থেকেই শেখ মুজিবই শীর্ষ আলোচনায় চলে আসেন তার বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার গুণে। বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। পাকিস্তানে মুসলিম লীগের অপশাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দল ও নেজামে ইসলামের সমন্বয়ে আওয়ামী মুসলিম যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৫৪ সালের পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায় এর মধ্যে এককভাবে ১৪৩টি আস পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। উল্লেখ্য, ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ২ বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ মুজিবের দূরদর্শিতা ছিল, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই রাজনৈতিক কারণে শেখ মুজিবের জেলখানায় আসা-যাওয়ার পালা শুরু হয়।

১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেই সম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি কেটে দেওয়া হয়। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে শক্তিশালী করতেই ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করা হয়। অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আদর্শকে লালন করে আওয়ামী লীগের পথচলা শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে দলে ভাঙন সৃষ্টি হয় পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক মতপার্থক্যের কারণে। এ বছরই ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারি সম্মেলনে দলের বিভক্তি ঘটে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। অপেক্ষাকৃত তরুণদের নিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন করেন। পাকিস্তানে শুরু হয় সামরিক স্বৈরশাসন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৬ সালের ৭ দফা ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তোলে। ৬ দফা মুক্তির সনদে পরিণত হয়। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন অবিসংবাদিত নেতা। ৬ দফার সমর্থন প্রত্যাশায় সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে এক বিশাল জনসভায় অনুষ্ঠিত হয়, সেই সভায় এম আজিজ সভাপতিত্ব করেন। সভায় ঘোষণা করা হয় ৬ দফা না মানলে এক দফার আন্দোলন শুরু হবে। সেটা হচ্ছে স্বাধীনতার আন্দোলন। এরই মধ্যে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হিসেবে মুক্তির কান্ডারিতে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিক্রমণে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ১৯৬৯-এর গণঅভুত্থান। এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটে। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আওয়ামী লীগসহ আরও কিছু ছাত্র সংগঠনকে একত্রিত করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করেন। আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অন্যায়ভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে বাঙালির ওপর বর্বর নির্যাতন শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে। গ্রেপ্তারের প্রাক্কালে ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেই মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা ঘোষিত হয়। ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হন, ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারান এই বাংলাদেশে। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাস কমবেশি সবাই জানেন। তবু বলতে হয়, যিনি সারাজীবন ত্যাগ স্বীকার করে এ জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিলেন, তাকে দেশীয় পরাজিত শক্তি ও আন্তর্জাতিক চক্রের ইন্ধনে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলেছিল। সৌভাগ্যক্রমে তার কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যাওয়ায় আমরা সগৌরবে-সমহিমায় বেঁচে থেকে এগিয়ে যেতে পারছি। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ ও বাঙালির বাতিঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক নানা কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে ৭৩ বছরে পা রাখা আওয়ামী লীগ আজ বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ অভিন্ন অর্থ বহন করে এগিয়ে যাচ্ছে।